ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতিতে, সমাজিক চালচলনে কিংবা পারিবারিক বন্ধনে আবদ্ধ থেকে কেউ কোন প্রাণঘাতী ভুল করে, সম্পর্ক নষ্ট করে কিংবা বন্ধন ছিন্ন করেও যদি তার একরোখা মনোভাব, কর্তৃত্বপরায়নতা কিংবা অহংকার-দম্ভ বহাল রাখতে চায় তবে আর বিচ্ছিন্ন সম্পর্ক জোড়া লাগে না। বরং যেটুকু সম্পর্ক থাকে তাও পাতলা হয়। ক্ষমতার লিপ্সায়, লোভের মোহে কিংবা সাম্রাজ্যবাদী মনোভাবের কারনে কারো দ্বারা ছোট-বড় ভুল হতেই পারে কিন্তু সেই ভুলকে স্বীকৃতি দিতে, প্রতিষ্ঠা করতে কিংবা যৌক্তিক প্রমাণ করতে আরও মহা ভুল পথে আগানো অন্যায়। যে রাষ্ট্রে রাজনীতি করতে হবে, যে সমাজে বাস করতে হবে এবং যে পরিবারে ঘনিষ্ঠভাবে বাঁচতে হবে সেখানে নত থাকা জরুরি। ভুল স্বীকার করা দরকারি। সে ভুল সরকারি পর্যায়ের হলেও জনতার কাছে বিনীত থাকতে হবে। শুধু পরের সাথে অন্যায় নয় বরং ঘরের সাথে অন্যায় করলেও পতন ত্বরান্বিত হতে পারে। ভুল পদক্ষেপ নিয়ে, ভুল বার্তা দিয়ে কিংবা প্রকাশ্য অন্যায় করেও যদি জেদ জিন্দা রাখি, প্রতিশোধের মনোভাব ধরে রাখি কিংবা দেখে নেওয়ার হুমকি-ধামকি দেই তবে পরিচিত পরিধির আওতাভূক্তদের মনে ঠাঁই মিলবে? মোটেই না। বর ঘৃণায় থুতু ফেলবে।
রাজনীতির ময়দান থেকে মসজিদের মিম্বর, চায়ের দোকান থেকে শুরু করে মন্দিরের বারান্দা- যারা যেখানে কাজ করে, কথা বলে তারা সবার মনোরঞ্জন করে চলতে পারে না। শতভাগ ন্যায়সঙ্গতভাবে কোন কাজ করা মানুষের পক্ষে মুশকিল। কিন্তু ভুল ধরা পরার পরে কিংবা কেউ ধরিয়ে দেওয়ার পরেও যদি সেটা শোধরানোর ইচ্ছার বিপরীতে আরও প্রতিশোধ পরায়ণতা জাগ্রত হয়, প্রতিহিংসায় দাপিয়ে বেড়ায় কিংবা কারো বড় ক্ষতি করে তার কাছে ক্ষমা না চেয়ে আরও অনেকের ক্ষতির ছক কষা হয়- তবে সেটার ক্ষতিপূরণ দিতে হয়। কখনো কখনো এই প্রতিশোধ জীবন দিয়েও মেটাতে হয় আবার ক্ষতিপূরণে জীবন নিয়েও দায় পূরণ করতে হয়। ভুলের উর্ধ্বে অবস্থানের সাধ্য মানুষের ক্ষমতার বাইরে। সবাই যেটাকে অন্যায় তবুও ক্ষমতার বড়াইয়ে সেই অন্যায় চালিয়ে গেলে কিছুদিন পাড় পাওয়া যেতে পারে কিন্তু ভুল থেকে মুক্তি মেলে না। ভুল থেকে ছাড় পাওয়া যায় কিন্তু ভুল কারো জীবন থেকে ছেড়ে যায় না। তখন দম্ভের সাম্রাজ্য ধ্বসে পড়ে, ক্ষমতার গণ্ডি ছেড়ে পালতে হয় কিংবা প্রিয়জনের সাথে প্রকাশ্য/গোপন বিচ্ছেদ ঘটে। মানুষের ঘৃণা জমতে জমতে যখন বিস্ফোরণ ঘটে তা সবকিছু লয়-প্রলয় হয়। প্রিয়জন শত্রুতে বদলে যায়।
মানুষের সাথে মানুষের যত অখাতির, শ্রদ্ধাবানের জন্য সম্মাহানির গল্প সেসব একরোখা স্বভাব থেকে সৃষ্ট। কখনো কখনো শাসক কিংবা পরিচালক নিজের সিদ্ধান্তে ভরাডুবির মুখোমুখি হয় আবার কখনো কখনো তার উজির-নাজিরের কুপরামর্শের কারনের সব অর্জন ম্লান হয়ে যায়। একজন শাসক. একজন মোড়ল কিংবা একজন কর্তা তার নিজস্ব মানুষের জন্য, দেশবাসীর জন্য যত কিছু করুক, যত কল্যাণ আনুক, সে যদি জেদী হয়, প্রতিহিংসা পরায়ণ হয় কিংবা মনোভাবে স্বৈরাচারের রিপু ধারণ করে তবে তার সব ভালোকাজ অল্প খারাপে মলিন হয়ে যায়। সর্বত্রই পচন ধরায়। যে মানুষ অনেকবেশি ভালোকাজ না করেও তার মন্দ কাজ, মন্দ আচরণ শূন্যে নামিয়ে আনে সে অধিক গ্রহনযোগ্যতা পায়। সম্মান ও দোয়ায় থাকে। অন্তত মানুষের হৃদয়ে ভালোবাসার স্থানে বসতের অধিকার সে অর্জন করে। যে আদরও করে আবার শাসনের নামে করে নিষ্ঠুর অত্যাচার- মানুষ তাকে পরিত্যাগ করে বাঁচে। তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। সেই বদ্ধ ভুলকারীকে কেউ ক্ষমা করে না বরং নতুনদের আরও বড় বড় ভুলে পুরাতন ভুল চাপা পড়ে এবং হারানো ভুল ফুল হয়ে ফেরে!
ছোট ভুল কিংবা বড় ভুলের যেমন ক্ষমা থাকা উচিত তেমনি ভুলকারীর ভুল স্বীকারের, দণ্ড গ্রহনের সদিচ্ছিাও জরুরি। আইনকে নিরপেক্ষভাবে এটা নিশ্চিত করতে হবে। যত বড় মানুষ তার ভুলের পরিমান-পরিধিও তত বেশি বিস্তৃত। বয়স্ক মানুষের সম্পদ, সম্মান এবং আয়ুর প্রতি লোভ বেড়ে যায়। তখন সে যেকোন পথে টিকে থাকতে চায়। এই পথে সে নীতিনৈতিকতা অগ্রাহ্য করে ভুলের পরিমান বাড়িয়ে চলে। তাকে সঙ্গ দেয় কিছু তস্কর এবং তাদের ভিন্ন উদ্দেশ্য থাকে। এই বদ উদ্দেশ্যের বলি হয় অবিবেচক শাসক. নীতিভ্রষ্ট সমাজপতি এবং পরিবারের বেওকুফ কর্তা নিজে ডোবে এবং দেশ, জাতি, সমাজ কিংবা পরিবারকে ডোবায়। জীবন-যৌবন, সম্পদ-সংসার দিয়ে খেসারত দিতে হয় অধিভূক্ত সদস্যদের। অল্প সংখ্যকের ভুলের জন্য, লাগামীহন লোভের জন্য দায় মেটাতে হয় নীরিহ অথচ সম-আদর্শের সমর্থকদের। ঘর ছাড়া হতে হয় তুলনামুলক দুর্বলদের এবং সম্মান যায় নিরাপরাধের। কতিপয়ের লোভের বলি হয় মানসভ্যতা। বাড়ে বিদ্বেষপ্রসূত অশান্তি। ধ্বংস হয় সম্প্রীতি। নষ্ট করে ঐক্য।
ভুল স্বীকার করলে অপরাধও কমে এবং পাপও কমে। কিন্তু কেউ যদি ভুল করেও ভুল স্বীকার না করে তবে সে দুনিয়াতে শাস্তি পায় কিন্তু পাপ কমে না। পাপের শাস্তি পরকালে। দুনিয়াতে কেবল ভুলের শাস্তি হয়।
ভুলের নিশ্চয়ই মাত্রাভেদ আছে। তবে প্রায়শ্চিত্ত করার, অনুতপ্ত হওয়ার বোধ সব মানুষেরর মাঝেই উপস্থিত থাকা উচিত। মানুষ হত্যা করা কিংবা ছিচকে চুরি করা- এই দুই অপরাধের দন্ড নিশ্চয়ই একরকম নয়। যখন অপরাধ করে কেউ ক্ষমা চায় তখন তার প্রতি মানুষের অন্তত সিমপ্যাথী বাড়ে। কিন্তু ভুল করেও যারা ভুল স্বীকার না করে ভুলের ওপর অবিচল থাকে তারা ভবিষ্যতে আরও বড় ভুলের গোড়াপত্তন করবে। আরও বেশি অপরাধে জড়াবে। দু’জনের মধ্যে পারস্পারিক ভুল কিংবা গোটা মানবগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ভুল- আত্মিক অপরাধবোধ জাগ্রত থাকা জরুরি। বিবেক পঁচে যাওয়া, মানবিক মূল্যবোধ হারিয়ে ফেলা মানুষগুলোই কেবল ভুল করেও সেই ভুলের ওপর স্থির থাকতে পারে। ভুল মানুষের ক্ষয় নিশ্চিত করে। ভুল থেকে তওবা করে না ফিরলে ভুলই একদিন আপনাকে/আমাকে মাটির সাথে মিশিয়ে দেবে! সুতরাং সাবধান!- ভুল করা থেকে, ভুল অস্বীকার না করা থেকে এবং ভুলে ভুলে জীবন না গড়া থেকে। ভুল মেনে নিয়ে ক্ষমা চকইলে কেউ ছোট হয় না।
রাজু আহমেদ, কলাম লেখক।
[email protected]
প্রধান বার্তা সম্পাদক ও চেয়ারম্যান: মো. আতিকুর রহমান
ভাইস-চেয়ারম্যান ও ডিরেক্টর: তানভীর আমের হোসেন (নুমান)
প্রধান সম্পাদক এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক: মো. রফিকুল ইসলাম
রিপোর্টিং ও প্রধান কার্যালয়: নাহার ম্যানশন (সি-৯), ১৫০ মতিঝিল সি/এ, ঢাকা – ১০০০। বাংলাদেশ।
ফোন: +88 09611-378696 , ইমেইল: [email protected]
© ২০২৪ ব্রডকাস্টিং নিউজ কর্পোরেশন কর্তৃক সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত