এই সমাজে মন্দ নিয়ে যত চর্চা হয় ভালো নিয়ে তত কথা আছে? দুর্নীতিবাজ লোকের থ্রিলার গল্প দেখতে দেখতে অস্থির অথচ সৎ কর্মকর্তারা তো মিডিয়ার লাইমলাইটে নাই। ক্যামেরা ফোকাস অন্যদিকে! আপনি দেশের দশজন রাঘব দুর্নীতিবাজের নাম সাত সেকেন্ডে বলে দিতে পারেন কিন্তু পাঁচজন সৎ কর্মকর্তার নাম দশ মিনিটে বলতে পারবেন? যেখানে সততার পুরস্কার নাই, সৎ ব্যক্তিদের নিয়ে চর্চা নাই এবং এমনকি সৎ লোকের ন্যায্য সম্মান যে সমাজে নাই সেই সমাজে সৎলোক জন্মাবে- এটা অনেকটাই কাল্পনিক। যে সৎভাবে চলে সে আলগা ফুটানি করতে পারে না, কেউ চাইলেই হাতভরে চাঁদা কিংবা দান করতে পারে না কিংবা ক্ষমতা অপব্যবহার করে রাম রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করে না। এমন সততার পক্ষে কে থাকে? দূরে সততার সমর্থক আছে কিন্তু কাছে কোন ছায়া নাই! অথচ সততা নিজেই বটবৃক্ষ।
বাংলাদেশের একটা গ্রাম কল্পনা করুন যেখানে দু’জন একই মর্যাদা সম্পন্ন কর্মকর্তার জন্ম। একজন ন্যায়নীতির তোয়াক্কা না করে দু’হাতে অর্থ কামিয়েছে, সম্পদ গড়েছে। অন্যজন সৎভাবে বেতনের ওপরেই নির্ভরশীল থেকেছে। যার অনেক আছে সে মসজিদ-মন্দিরে দান করে, সাহায্যের জন্য কেউ এলে ফেরায় না। তার গ্রামে আগমন মানেই উৎসব। লোকজন হুমড়ি খেয়ে পড়ে। কত কত সুপারিশ থাকে। ছেলের চাকুরি থেকে মামলার তদবির। আর যার বাড়তি পয়সা নাই সে কারো জন্য তেমন কিছুই করতে পারে না। সবাই কেবল সৎ হতে বলে, কম খেতে বলে এবং ভালো কাজ করতে বলে। যখন তাঁর অসামর্থ্যের কথা বলে তখন লোকে নিন্দা শুরু করে। এই লোক বজ্জাত! যেখানে সে জন্মেছে সেখানের মানুষের জন্য কিছুই করেনি। কোন কৃতজ্ঞতা বোধ নাই। এমন কথা যখন তার কানে আসতে শুরু করে তখন গ্রামে যাতায়াত কমিয়ে দেয়। রুট থেকে ধীরে ধীরে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এমন চিত্র কী আপনার আশেপাশে নাই?
কে কত টাকা-সম্পদ গড়তে পারবে সেই ধান্ধাবাজিতে অনেকেই মাতোয়ারা। সেটার উৎস বৈধ নাকি অবৈধ- এই চিন্তা ক’জনে করে? অথচ যে সৎ তার সাধারণভাবে দিন গুজরান করতে হয়। সে কারো তদবির রাখে না, কাউকে অন্যায় সুযোগ দেয় না। সুতরাং লোকের সাথে তার ভাব জমে না। সর্বত্রই যেখানো দুষ্ট লোকের জয়জয়কার সেখানে সৎ লোকগুলো বাড়তি বোঝার মত! ঘুষ নিয়ে এরা অবৈধকে বৈধ করে না বলে আরও বহুজনের শত্রুতে পরিণত হয়। তখন দুষ্ট চক্র ভালো মানুষগুলোকে চেপে ধরে। চরিত্র হনন করে। সততা তখন অপরাধ মনে হয়! অসততার যে প্রবল জোয়ার তা সমাজের সর্বত্রই লক্ষণীয়। একজন সৎ কর্মকর্তাকে নিয়ে আলোচনা করতে মানুষের ইচ্ছা নাই। সমাজে সততার কোন পুরস্কার নাই। বরং দুর্নীতিবাজরাই এখন বর্তমান তরুণদের রোল মডেল। বেনজির-মতিউর কর্মকাণ্ড সম্পর্কে তরুণদের বিশাল আগ্রহ অথচ প্রয়াত আমলা আকবর আলি খান, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ফরাসউদ্দীন কিংবা সালেহ উদ্দিন প্রমুখের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে আমরা কতটুকু জানি? দুঃখজনক হলেও সত্য, সততাকে আজকাল খুব কম লোকেই আদর্শ মানে।
যিনি যত-বেশি পীড়ন করতে পারেন, যত-বেশি ক্ষমতা দেখান তাকে ততবেশি মানুষ নম: নম: করে। লোকাল রাজনীতিতে যার যতবেশি সহিংসতা করার জনবল আছে সে ততবেশি ভোটারের এটেনশন পায়। এই যে সমাজে সততার পক্ষে লোকের না থাকা এটাই দুর্নীতিকে আরও বেশি উৎসাহিত করেছে। সমাজ থেকে ভালো মানুষ আশঙ্কাজনক-ভাবে কমে গেছে। বেনজির মতিউর নিয়ে চর্চা বেশি কারণ তাদের দুর্নীতি সকলের মন কেড়েছে! টাকা থাকলে এতো টাকাই থাকা উচিত! আরও যে লাখো ছোট ছোট দুর্নীতিবাজ আছে তারাও সবেগে উৎসাহিত হয়ে কুকাজ চালিয়ে যাচ্ছে! প্রত্যন্ত অঞ্চলের বিধবা-বয়স্কদের কার্ড প্রদানে জালিয়াতি থেকে শুরু করে উচ্চতর পর্যায় পর্যন্ত যারা ধরা পড়ে তাদের দু’চারজনকেই জানতে পারি। অথচ এই দুর্নীতিবাজ দলের সদস্য সংখ্যা কত? বেহিসাব। বেমালুম ছেড়ে দিয়েছি।
রাষ্ট্রীয়ভাবে কাগজ-কলমে শুদ্ধাচারের ব্যাপক চর্চা হয়, রাজনৈতিক বক্তৃতায় এবং সেবকদের কর্মশালায় নীতি-নৈতিকতা শেখানো হয় তবে ব্যক্তিজীবনে এর চর্চা ও প্রভাব কতোখানি তা মূল্যায়ন হওয়া জরুরি। মানুষ স্বার্থের মুখোমুখি দাঁড়ালে তার নৈতিক বোধ কেন ভোঁতা হয়ে যায়? যে মানুষ নীতির কথা বলে, সেজদায় কপালে দাগ ফেলে সেই মানুষ যখন ফাইল আটকিয়ে ঘুষ নেয়, অবৈধকে পুরস্কারে বৈধ ঘোষণা করে তখন বোধহীন বিমুগ্ধতায় ব্যাকুল হতে হয়! মানুষের এই দ্বিচারিতা জনতাকে উৎসাহিত করে- যাতে তারাও দুর্নীতি করে! তখন রিকশাওয়ালার পাঁচ টাকার ভাড়া পনেরো টাকা হয়ে যায়, মাংস বিক্রেতার এক কেজি মাংস ৮৫০ গ্রামে ঠেকে। দুর্নীতির এই যে চেইন তা একদিনে সৃষ্টি হয়নি আবার একদিনে বন্ধ হবে না। তবে স্মরণকালের সবচেয়ে ক্ষয়িষ্ণু সময় অতিবাহিত হচ্ছে। যে সৎ আজকাল লোকে তাকে বোকা বলে। যে বেতনের বাইরে অর্থের কথা ভাবে না, সমাজ তারে পিছিয়ে রাখে।
সততার কী আদৌ পুরস্কার নাই। অবশ্যই আছে। সৎ মানুষ মানসিকভাবে শক্তিশালী থাকে। কিছু মানুষের দোয়া পায়। অন্তত লোকে তাদের ভালো মানুষ বলে। সৎ মানুষের সন্তান খারাপ হয় না। সততার যে বল তা সৎকে শক্ত রাখে। এই সমাজে এখনো যেটুকু শৃঙ্খলা ও বাসযোগ্যতা আছে তা সৎ মানুষগুলোর জন্যে। সৎ মানুষগুলোর কর্মকাণ্ডকে হাইলাইটস করা জরুরি। অন্তত প্রজন্মের সামনে সততার আদর্শ পরিচিত করার স্বার্থে মিডিয়াগুলোকে অসৎ সম্পর্কে ঘৃণা জন্মানো এবং সৎ সম্পর্কে সম্মান জানানোর প্রেক্ষিত তৈরি করতে হবে। অসৎদের যেমন বয়কট করতে হবে তেমনি সৎ সজ্জনকে সামাজিক সম্মান ও রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দিতে হবে। অসৎ মানুষের সংবাদ কর্মকর্তাদের সম্পর্কে সমাজে নেগেটিভ পার্সেপশান তৈরি করেছে। সৎ কর্মকর্তার সততার গল্প বলে হারিয়ে যাওয়া শ্রদ্ধা ফিরিয়ে আনতে হবে। এখনো অসৎ মানুষের চেয়ে সৎ মানুষের সংখ্যা বেশি। ভালোমানুষগুলো পদাধিকারী হলে সেবার মান ও ধরণ বদলে যাবে। তবেই স্মার্ট বাংলাদেশের গঠন সহজ হবে।
রাজু আহমেদ, কলাম লেখক।
[email protected]
প্রধান বার্তা সম্পাদক ও চেয়ারম্যান: মো. আতিকুর রহমান
ভাইস-চেয়ারম্যান ও ডিরেক্টর: তানভীর আমের হোসেন (নুমান)
প্রধান সম্পাদক এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক: মো. রফিকুল ইসলাম
রিপোর্টিং ও প্রধান কার্যালয়: নাহার ম্যানশন (সি-৯), ১৫০ মতিঝিল সি/এ, ঢাকা – ১০০০। বাংলাদেশ।
ফোন: +88 09611-378696 , ইমেইল: [email protected]
© ২০২৪ ব্রডকাস্টিং নিউজ কর্পোরেশন কর্তৃক সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত