।।এক।।
ঈদ কুরবানি কিংবা লম্বা বিরতিতে গ্রামের সহজ সরল মানুষের সাথে সময় কাটাতে চেষ্টা করি। এবারেও রীতির ব্যতিক্রম হয়নি। গ্রামের মুরুব্বিদের সাথেই বেশি মিশি ও বসি। সে আসরে বাহারি আলাপন শুনতে পাওয়া যায়। নেতিবাচক কথাবার্তার শীর্ষে থাকে পরের নামে বদনাম কিংবা কুষ্ঠি-ঠিকুজি উদ্ধার। অবাক হয়ে এবার তাদের নীতি-নৈতিকতার হালহকিকত শুনলাম। আইন-কানুনে ঘুষ-দুর্নীতির ব্যাপারে যা কিছু আছে তা তারাও মানে তবে তা অন্যের বেলায়! বেনজীর গংদের কঠিন সাজা হোক- সেটা তারাও চায়। তবে তাদের আপন পোলায় কিভাবে কামাই করে, বেতন কত পায় তা নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নাই। চিন্তা বলেন আর দুশ্চিন্তা সেটাতে কেবল টাকা-কড়ির স্বপ্ন থাকে। স্বপ্ন জোড়া স্বার্থ থাকে। কাকে ঠকিয়ে, কোন পথে অর্থ-বিত্ত এলো সেটা তাদের কাছে বিবেচ্য নয়। সেই ঘুষ দুর্নীতি, সুদ আর জালিয়াতির টাকায় কেউ কেউ মক্কা মদিনায় যায়, কোরবানি দেয় এবং মসজিদ-মন্দিরেও দান সদকা পাঠায়। বেকার সন্তানের জন্যও টাকা জমিয়ে রেখেছেন যাতে ফেলো কড়ি মাখো তেলের সূত্রে ঘুষ দিয়ে চাকরি পেয়ে যেতে পারে- সেই ভাবনায় আছে! দু’চারজন নেতাকেও ভাবনায় রেখেছেন, তাদের দলকে সমর্থন করছে যাতে তারা সুপারিশ করে দিতে পারে!
গ্রামে এ বছর কুরবানি-দাতাদের হার তুলনামূলক কম। যারা সামর্থ্য মত কুরবানি করেছে তাদের সিংহভাগের গোশত ফ্রিজ খেয়ে নিয়েছে। পূর্বে প্রতিষ্ঠিত রীতির সেই তিনভাগের একভাগ গরীবের চুলায় ওঠেনি। জটলা পাকিয়ে পরের নামে দুর্নাম করা, খুঁত বের করে সেগুলো চিবানো, কার স্বামী/বউ, পুত্র/কন্যা কী করে সেগুলোর নিন্দায় মজমা বসানো- অল্প কয়েক বছর আগেও এসব গ্রামে দেখিনি। বিপদে আপদে সবাই সবার পাশে দাঁড়াতো, হাসিখুশি থাকতো অথচ এখন সম্পূর্ণ ভিন্নরূপ। সামাজিক যোগাযোগ-মাধ্যমের মাধ্যমে শহরের স্বার্থপর আবহাওয়া গ্রামকে ভালোভাবেই গ্রাস করেছে। দিনে দিনে যা পচানির তলানিতে নিচ্ছে! চায়ের দোকানে, অমুকের উঠোনে একজন আরেকজনের দোষ শামুকের মত জড়িয়ে ধরে! কারো উন্নতি এখানে চক্ষুশূল। ঘুষ-দুর্নীতি করে যারা আঙুল-ফুলে কলাগাছ হয়েছে তাদের পেছনে একরকম আলোচনা আর সম্মুখে অবনত মস্তকে নম: নম: করা গ্রাম্য মানুষের দ্বিচারিতা রীতিমতো অবাক করেছে। এই কি সেই আবহমানকালের বাংলার চিরাচরিত রূপ? যারা এখন সত্য বলতে ভয় পায়। কৌশল করে বাঁচে। জোঁক হয়ে স্বার্থ আদায় করে। যাদের আলোচনায় কৃষি কম, মানুষের বিষ্ঠা বেশি!
এই অসুখ সাদামাটা সহজপ্রাণা মানুষগুলোর অন্তরে কবে, কোথা হতে লেগেছে তা সমাজ সংস্কারকরা খুঁজে বের করে মলম মালিশ করুক। নীতি-হীনতার যে দৌড় তা থামানো উচিত। সমাজ পচে গেছে বলে রাজনীতিতে খারাপ হাওয়া লেগেছে নাকি রাজনীতিতে অপরাজনীতি শুরু হয়েছে বলে সমাজেও সেটার জের এসে ঠেকেছে সেটা আবিষ্কার করা আবশ্যক। গ্রামের মেম্বর-চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে উপজেলা পরিষদ এবং জাতীয় নির্বাচনের পরে সহিংসতা এমন উদ্বেগের কখনোই ছিল না! আতঙ্কের এহেন কালো মেঘ কখনোই ঘনাতে দেখিনি। যুগের হুজুগ সব পাল্টে দিয়েছে। ভোটকে কেন্দ্র করে শতকোটি টাকার লেনদেন মানুষ আগে কখনোই শোনেনি! সুদ-ঘুষের সমর্থন এবং ভ্রষ্ট চেতনার লালন কীভাবে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছে সেটা উন্মোচিত হওয়া আবশ্যক। নয়তো ধ্বংসের দামামা বোধ-বিবেকের জিজ্ঞাসা ডালে-মূলে বিনষ্ট করবে। মানুষের প্রতি মানবিকতা-বোধ, সহনশীলতা ও পরমত সহিষ্ণুতার যে অভাব লক্ষণীয় হয়েছে তা স্বার্থের ঊর্ধ্বে ওঠে নিরাময় করতে হবে।
।।দুই।।
সাম্প্রতিক গণপ্রজাতন্ত্রীর কয়েকজন সাবেক ও বর্তমান কর্মচারীর বিরুদ্ধে বিশাল আর্থিক ও ক্ষমতা অপব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে। যেহেতু এখনো সেটা আদালতে প্রমাণিত হয়নি তাই সে বিষয়ে চূড়ান্ত মন্তব্য শোভনীয় নয়। তবে কিছুটা এদিক-সেদিক যে হয়েছে তা সন্দেহাতীতভাবে প্রকাশ্যে এসেছে। অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতাও মেদিকে ইশারা দিচ্ছে। শুধু অভিযুক্তরা নন বরং দুর্নীতির এই শেকলের সাথে আরও অনেকেই জড়িত এবং পদ ও ক্ষমতা ব্যবহার করে সাগর চুরি করা সাগরেদ এই রাজ্যে কম নেই! নয়তো নির্ধারিত বেতনে পাহাড়-সম আয় কী করে হয়? সরকারি সেবা সহজলভ্য করার লক্ষ্যে রাষ্ট্রীয় প্রয়াসকে একশ্রেণীর লোভী, অসৎ কর্মচারীর সিন্ডিকেট কঠিন করে রেখেছে। ফেলো মাল তোলো সামান রীতিতে তারা রাষ্ট্রীয় বেতন ভাতা এবং সেবাগ্রহীতার কাছ থেকে উপরি কামাই- দু’টোই গ্রহণ করছে। যাতে রাষ্ট্রের ক্ষতের খতিয়ান বাড়ছে। সমপর্যায়ের হয়ে তুমি ঘুষ খেয়ে তেলের মত আছ আর আমি নিরামিষ কেন র’বো- এই নীতিতে অন্যায়ের চেইন দিনে দিনে লম্বা ও মোটা হচ্ছে! চেইনে শেষ মাথার দৈত্য-দানবের দু’একজন কালেভদ্রে প্রকাশ্যে এলেও চুনোপুঁটির সংখ্যা এবং তাদের সামষ্টিক হিস্যা দানবের চেয়ে বহুগুণ বেশি!
শুধু সরকারের সাথে জড়িত কারো দুর্নীতির খোঁজ পেলে সুশীল, সাংবাদিক এবং জনতা সেখানে যেভাবে হামলে পড়ে সেভাবে বেসরকারি দুর্নীতি নিয়ে আলাপে তাদের আগ্রহ নাই! ব্যবসায়িক সিন্ডিকেট রাতারাতি হাজার কোটি টাকা লোপাট করে দেয়, রাষ্ট্রের মেরুদণ্ড পাচার করে আখের কামায়, দাম বাড়িয়ে এবং মালের সরবরাহ কমিয়ে জনগণকে জিম্মি করে- সে বিষয়ে সচেতনতা সর্বত্রই কম। অথচ দুর্নীতি সর্বাঙ্গেই দুর্নীতি হিসেবে বিবেচ্য হওয়া উচিত। ধিক্কার এবং বয়কট বহু সংকটের সমাধান আনতে পারে। ঘৃণার তেজ বাড়াতেই হবে। হুজুগ ত্যাগ করে জনসচেতনতার মাধ্যমে দুষ্টকে পরিত্যাজ্য করতে হবে। দেশীয় রীতিতে ক্ষমতা ও পদ-পদবীতে থাকলে তার বিরুদ্ধে কলম ও মুখ চালনায় ঝুঁকি থাকে! কাজেই কিছু সাবেকের দুর্নীতি উন্মোচন করে আমৃত্যু জেলের মধ্যে রাখতে পারলে পরবর্তীদের জন্য দৃষ্টান্ত হতো। অসততার পরিণতি চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে হবে। দণ্ডের কলম একবার তুললে আবার বহু সময় নির্বিঘ্নে বিশ্রাম করা যেতো।
অসৎ পয়সায় ইবাদত, লোক দেখানো আচরণ আর মুখোশের শুদ্ধাচার কোন কাজে আসবে না। স্কুল-কলেজে শেখানো নৈতিকতা আর দেশপ্রেম ব্যর্থ হবে যদি পরিবারে সেসবের চর্চা না থাকে। শুদ্ধতা চর্চার চারণভূমি হিসেবে সমাজকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। একই সমাজে যদি দু’রীতি চালু থাকে, আইনের চোখ যদি ভিন্ন ভিন্ন দেখে তবে দুষ্টের পালন বাড়বে। দুষ্টের সাহস ইতোমধ্যেই বেড়েছে। কোন দুর্নীতিবাজ রথী-মহারথীদের জন্ম ও বেড়ে ওঠা একদিনে হয়নি। তাদের এই অসততার যাত্রার পথে পথে রাষ্ট্রের বাঁধা দেওয়া উচিত ছিল। কোন দফতরের মাথা যখন অসুস্থতায় ভোগে তখন হাত-পা বিকল হতে বাধ্য হয়। আত্মার সংশোধনের চেয়ে হুকুম সংশোধিত হয়ে যদি সবার ওপরে ন্যায় চাপিয়ে দেয়া যায় তবে সেটি বেশি ফলপ্রসূ হয়। তাছাড়াও ব্যক্তির সংশোধন, জাতির সংশোধন এবং শাসকের সংশোধন সমান্তরাল করতে হবে। ভণ্ডের রাজ্যে দরবেশের সংখ্যা কমে গেলে শুদ্ধতার সম্ভাবনা শঙ্কায় হারায়। দুর্নীতি রাজ্যজুড়েই ব্যাধি। সার্বিকভাবে একে রোধ করতেই হবে। প্রয়োজনে আমাদেরও আন্না হাজারের জন্ম দিতে হবে। সংবিধানের ন্যায়পাল বাস্তবে আনলে বোধহয় জনমনে স্বস্তি বাড়বে।
রাজু আহমেদ, কলাম লেখক।
[email protected]
প্রধান বার্তা সম্পাদক ও চেয়ারম্যান: মো. আতিকুর রহমান
ভাইস-চেয়ারম্যান ও ডিরেক্টর: তানভীর আমের হোসেন (নুমান)
প্রধান সম্পাদক এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক: মো. রফিকুল ইসলাম
রিপোর্টিং ও প্রধান কার্যালয়: নাহার ম্যানশন (সি-৯), ১৫০ মতিঝিল সি/এ, ঢাকা – ১০০০। বাংলাদেশ।
ফোন: +88 09611-378696 , ইমেইল: [email protected]
© ২০২৪ ব্রডকাস্টিং নিউজ কর্পোরেশন কর্তৃক সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত