All Menu

বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম : উদ্যোক্তা সংস্কৃতি ও প্রযুক্তির সম্ভাবনা

 

 

বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম একটি অদম্য শক্তি; যাদের মেধা, উদ্ভাবনী চিন্তা ও সাহসিকতা দেশের ভবিষ্যৎ বদলে দিতে পারে। তারা এখন আর শুধু চাকরির পেছনে নয়, বরং উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। তাদের উদ্যোগ দেশের অর্থনীতিতে নতুন কর্মসংস্থান তৈরি করছে এবং বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশের পরিচিতি বাড়াচ্ছে। তরুণদের উদ্যোক্তা হওয়ার এই মানসিকতা আমাদের দেশের উন্নয়নে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২২ সালের জনশুমারির তথ্য অনুযায়ী, দেশের মোট জনসংখ্যার ৩৪ দশমিক ২৬ শতাংশ তরুণ, যাদের বয়স ১৫ থেকে ২৪ বছরের মধ্যে। এই বিশাল যুব জনগোষ্ঠী দেশের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এছাড়া, বাংলাদেশ ১৫-৬৪ বছর বয়সি জনগোষ্ঠীকে কর্মক্ষম হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যার হার সর্বাধিক ৯৪ দশমিক ৭০ শতাংশ, যা দেশের সম্ভাব্য “ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড” বা জনসংখ্যাগত সুযোগ হিসাবে দেখা হচ্ছে। এটি দেশের তরুণ প্রজন্মকে দক্ষ ও সৃজনশীল কাজে সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে উন্নয়নের একটি বড়ো সম্ভাবনা সৃষ্টি করছে, বিশেষত উদ্যোক্তা সংস্কৃতির প্রসার এবং কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে।

তরুণ উদ্যোক্তাগণ প্রযুক্তির এই যুগে প্রতিটি ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বাংলাদেশের তরুণেরা এই প্রযুক্তিগত উন্নয়নের সঙ্গে নিজেদের একাত্ম করেছে। তথ্যপ্রযুক্তির বিস্তৃতি এবং ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা তরুণদের হাতের নাগালে প্রযুক্তির সুযোগ নিয়ে এসেছে। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউবসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো শুধু বিনোদনের জন্যই নয়, বরং উদ্যোক্তা কার্যক্রমের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তরুণেরা বর্তমানে অনলাইন শপিং প্ল্যাটফর্ম, এফ-কমার্স (ফেসবুক-কমার্স), ফ্রিল্যান্সিং এবং অ্যাপ ডেভেলপমেন্টের মাধ্যমে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিশাল অবদান রাখছে। ডিজিটাল মার্কেটিং, ওয়েব ডেভেলপমেন্ট, মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন ডেভেলপমেন্ট এবং এফ-কমার্সের মতো সেক্টরগুলোতে তরুণ প্রজন্ম সফলভাবে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করছে। তরুণদের মেধা ও উদ্ভাবনী চিন্তাধারা দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনে একটি বিশাল ভূমিকা রাখছে।

বড়ো পুঁজি ছাড়াই ছোটো উদ্যোগের মাধ্যমে মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন সম্ভব। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ক্ষুদ্রঋণের ধারণা এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এই ক্ষুদ্রঋণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে স্বাবলম্বী হতে সাহায্য করেছে। গ্রামীণ ব্যাংকের ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে অসংখ্য মানুষ নিজেদের ছোটো ব্যাবসা শুরু করে অর্থনৈতিকভাবে উন্নতির দিকে এগিয়েছে।

তরুণ উদ্যোক্তারা যে শুধু সাফল্য পাচ্ছে তা নয়, তারা নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখিও হচ্ছে। বেশিরভাগ তরুণদের কাছে প্রাথমিক পুঁজি বা বিনিয়োগের ব্যবস্থা নেই। ব্যাবসা শুরু করার জন্য ব্যাংক ঋণ পাওয়া এখনও সহজ নয়, বিশেষত যখন কেউ নতুন। তরুণদের মধ্যে অনেকেই পরিবার থেকে সমর্থন পায় না। কারণ এখনও আমাদের সমাজে কিছু অংশে উদ্যোক্তা হওয়াকে ঝুঁকিপূর্ণ মনে করা হয়। অন্যদিকে প্রযুক্তিগত শিক্ষা ও দক্ষতার অভাবও একটি বড়ো চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশের কিছু অংশে এখনও তথ্যপ্রযুক্তির পূর্ণ সুবিধা পৌঁছেনি। উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও সুযোগের অভাবে অনেক তরুণের কাছে প্রযুক্তি সম্পর্কিত ধারণা সীমিত। এই সমস্ত চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও তরুণেরা তাদের অদম্য ইচ্ছাশক্তির মাধ্যমে নিজেদের স্বপ্নপূরণে চেষ্টা করে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ সরকার তরুণ উদ্যোক্তাদের সহায়তায় নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। আর্থিক সহায়তার পাশাপাশি বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কর্মসূচির মাধ্যমে তাদের দক্ষতা উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করছে। ‘স্টার্টআপ বাংলাদেশ’ ও ‘আইডিয়া’ প্রকল্পের মাধ্যমে তরুণ উদ্যোক্তারা ব্যাবসা পরিচালনা, উদ্ভাবন, ডিজিটাল প্রযুক্তি ও মার্কেটিং-এর উপর প্রশিক্ষণ পাচ্ছেন। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদপ্তর উদ্যোক্তাদের প্রযুক্তি, ই-কমার্স, ফ্রিল্যান্সিং, এবং ডিজিটাল মার্কেটিং-এর মতো প্রশিক্ষণ প্রদান করছে। পাশাপাশি বেসিস ও উইডেভস একাডেমি তরুণদের আইটি, ফ্রিল্যান্সিং এবং সফটওয়্যার ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ দিয়ে আন্তর্জাতিক পরিসরে তাদের প্রতিভা তুলে ধরার সুযোগ তৈরি করছে। যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর ৬৪ জেলা কার্যালয়ে বিভিন্ন মেয়াদি প্রশিক্ষণ শুরু করেছে। এর মধ্যে রয়েছে, গবাদি পশু, হাঁস-মুরগি পালন, মৎস্য চাষ ও প্রাথমিক চিকিৎসা বিষয়ক প্রশিক্ষণ। এছাড়া, প্রফেশনাল গ্রাফিক্স ডিজাইন, ফ্রিল্যান্সিং, আইটি এবং নেটওয়ার্কিং বিষয়েও প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে, যা তরুণ উদ্যোক্তাদের দক্ষতা উন্নয়নে সহায়তা করবে। সরকারের এই উদ্যোগ বেকারত্ব কমাতে এবং দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এছাড়াও মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর দর্জি বিজ্ঞান, ব্লক-বাটিক, টাই-ডাই, এমব্রয়ডারি এবং অন্যান্য কারিগরি প্রশিক্ষণ প্রদান করে থাকে। পাশাপাশি বিউটিফিকেশন, ড্রেস মেকিং, টেইলারিং, মাশরুম ও জৈব চাষাবাদ এবং পেস্ট্রি ও বেকারি বিষয়েও প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর মোট ১৯ হাজার ৭১২ জনকে বিভিন্ন কোর্সে প্রশিক্ষণ প্রদান করেছে। এসব প্রশিক্ষণের ফলে মহিলারা নিজস্ব ছোটো ব্যাবসা শুরু করতে পারছে, যা তাদের পরিবারের আর্থিক অবস্থার উন্নতি করছে। এই উদ্যোগ নারীদের ক্ষমতায়ন ও সমাজে তাদের অংশগ্রহণ বাড়ানোর লক্ষ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে ।

বাংলাদেশের তরুণ ও নারী উদ্যোক্তারা দেশকে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী করতে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করছে। তাদের জন্য উপর্যুক্ত প্রশিক্ষণ, আর্থিক সহায়তা এবং সুযোগ সৃষ্টি করা হলে তারা দেশের উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় বড়ো ভূমিকা রাখতে পারবে, এমনটাই প্রত্যাশা। (পিআইডি ফিচার)

লেখকঃ আয়েশা সিদ্দিকা

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top