ঈদুল-আজহার অন্যতম অনুষঙ্গ হলো পশু কুরবানি। এই কুরবানি ধর্মপ্রাণ মুসলমানকে ত্যাগের আদর্শে অনুপ্রাণিত করে। কিন্তু কুরবানির বর্জ্য যদি পরিবেশ দূষণের কারণ হয়, তাহলে সেই কুরবানি দিয়ে কি মনকে পরিশুদ্ধ করা সম্ভব? পরিবেশ দূষণ কুরবানির পবিত্রতাকে ম্লান করে দেয়। কুরবানির সময় পরিবেশকে দূষণ-মুক্ত করতে হলে কুরবানির বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ ও তা বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।
কুরবানির বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় গুরুত্ব সহকারে মেনে চলা প্রয়োজন। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে স্থান নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত বসতবাড়ি থেকে কুরবানির জায়গা একটু দূরে হওয়া উচিত। পশু জবাইয়ের জায়গা ভালো করে পরিষ্কার করে একটি গর্ত করতে হবে, যাতে জবাই-কৃত পশুর সম্পূর্ণ রক্ত গর্তে জমা হতে পারে। পশু জবাইয়ের পরে গর্ত মাটি দিয়ে এমনভাবে ঢেকে দিতে হবে যেন দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়তে না পারে। পৌরসভা বা সিটি কর্পোরেশন এলাকার ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের নির্ধারিত স্থানে কুরবানি করতে হবে। যদি কুরবানির পশু নির্ধারিত স্থানে সঠিক প্রক্রিয়ায় জবাই করা হয়, তাহলে একদিকে যেমন পরিবেশ দূষণ রোধ হবে; অন্যদিকে জবাই-পরবর্তী উচ্ছিষ্টাংশকে সহজে সম্পদে রূপান্তরিত করা যাবে। জবাই-কৃত পশুর ফেলে দেওয়া নাড়ি-ভুঁড়ি থেকে উৎকৃষ্ট-মানের মাছের খাদ্য বা পশুখাদ্য তৈরি করা সম্ভব, একইভাবে পশুর হাড় গুঁড়া করে পশুখাদ্য বা উৎকৃষ্ট মানের সারও তৈরি করা যায়। পশু-বর্জ্যকে এভাবে সঠিক পরিকল্পনা অনুযায়ী ব্যবস্থাপনার আওতায় নিয়ে আসা গেলে পরিবেশ দূষণ-মুক্ত থাকবে এবং বাণিজ্যিকভাবে লাভবান হওয়া যাবে। এছাড়া নির্ধারিত স্থানে কুরবানির ব্যবস্থা করলে সঠিকভাবে চামড়া ছাড়ানো সহজ হয়।
তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশে কুরবানির পশুর বর্জ্য খোলা জায়গায় বা ড্রেনে ফেলা দেওয়ার একটা প্রবণতা লক্ষ করা যায়। এভাবে কুরবানির পশুর বর্জ্য যত্রতত্র ফেলে দিলে পরিবেশ মারাত্মকভাবে দূষিত হয়, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ। এজন্য কুরবানির পশুর সব ধরনের বর্জ্য বড়ো আকারের গর্ত করে তার মধ্যে রেখে মাটিচাপা দিতে হবে। পৌরসভা বা সিটি কর্পোরেশন এলাকার ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের নির্ধারিত স্থানে বর্জ্য রেখে দিতে হবে, যাতে পরিচ্ছন্নতা-কর্মী সময়মতো সেগুলো অপসারণ করতে পারেন। পশুর চামড়া ছাড়ানো ও মাংস সংগ্রহের পরে কুরবানির জায়গা ভালোভাবে ধুয়ে ফেলতে হবে এবং যথেষ্ট পরিমাণ ব্লিচিং পাউডার ছিটিয়ে দিতে হবে।
বর্জ্য ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি আরেকটি বিষয় জরুরি, তা হচ্ছে চামড়া ব্যবস্থাপনা। চামড়া ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে। চামড়া ছাড়ানোর পর লবণ দিয়ে সংরক্ষণের আগে অবশ্যই চামড়ায় লেগে থাকা চর্বি, মাংস, রক্ত, মাটি ও গোবর ভালোভাবে পরিষ্কার করতে হবে। চামড়া ছাড়ানোর ৪-৫ ঘণ্টার মধ্যে অবশ্যই লবণ লাগাতে হবে। কাঁচা চামড়া সংরক্ষণের জন্য এমনভাবে লবণ লাগাতে হবে, যেন চামড়ার ভেতরের কোনো অংশ ফাঁকা না থাকে। লবণ দেওয়া চামড়া এমন জায়গায় রাখতে হবে, যেখানে আলো-বাতাস চলাচলের স্বাভাবিক ব্যবস্থা রয়েছে। অস্থায়ীভাবে সংরক্ষণ করা চামড়ার গুণগত মান রক্ষা করে সুবিধাজনক সময়ে ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রির ব্যবস্থা করতে হবে।
কুরবানির পর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা না করে তড়িঘড়ি করে মাংস নিয়ে বাড়িতে যাওয়ার মানসিকতা কুরবানির মূল চেতনার পরিপন্থী। এটি ত্যাগের নয়, বরং ভোগের মানসিকতা। আমাদের এই মানসিকতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। প্রত্যেক কুরবানি-দাতাকে কুরবানির পশুর বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে এবং তা বাস্তবায়নে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
কুরবানির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। পরিবেশ অধিদপ্তর, জেলা তথ্য অফিস-সহ বিভিন্ন সরকারি দপ্তর এ বিষয়ে জনসচেতনতামূলক প্রচার কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে। তবে জনসচেতনতামূলক প্রচার কার্যক্রম আরও বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিগণকেও কুরবানির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে।
মনে রাখতে হবে, পরিবেশকে ভারাক্রান্ত করলে কুরবানির পবিত্রতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে। কুরবানির পশুর বর্জ্য যেন সামান্যতম পরিবেশ দূষণের কারণ না হয়, সে বিষয়ে সবাইকে সচেতন থাকা উচিত। পশু কুরবানির মাধ্যমে কুরবানি-দাতার আত্মার আত্মশুদ্ধির পাশাপাশি পরিবেশের শুদ্ধতাও নিশ্চিত হবে, এমনটাই প্রত্যাশা। (পিআইডি ফিচার)
লেখক : ফাতেমা জান্নাতুল ফেরদৌস সুরভী, বিসিএস তথ্য ক্যাডারের কর্মকর্তা এবং তথ্য অফিসার পদে আঞ্চলিক তথ্য অফিস, রংপুর-এ কর্মরত।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।