সন্তানের জন্য বাবা-মায়ের দোয়া অবশ্যই কবুল হবে- ধর্মবেত্তাগণ এই বাক্য ফলাও করে প্রচার করে থেমে আছেন! অথচ এতে সামান্য যে শর্তটুকু সংযোজিত আছে সেটুকু তারা বলতে নারাজ! তাতে যে তাদের মর্তবাও কমবে। যে বাবা ঘুষ খায়, মন্দে লিপ্ত কিংবা প্রাপ্ত দায়িত্বে ফাঁকি দেয় সেই বাবার সন্তানের নামে দোয়া যে অভিশাপ- তা আর বলা হয়নি। যে মা বিপথগামী, আত্মীয় স্বজন থেকে সংসারকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছেন কিংবা স্বামী-সংসারের জন্য নিপীড়নকারী সে মায়ের দোয়াও সন্তানের জন্য অকল্যাণকামী- তা প্রচার করা হয়নি।
যত মন্দ কাজ আছে তার মধ্যে নিজেদেরকে বন্ধক রেখে সন্তানের জন্য হাজার রকম পন্থায় কল্যাণকামী হলেও কল্যাণ ধরা দেবে না। মন্দ কাজে অন্ধ থাকা বাবা-মায়ের দোয়া আকাশের ঠিক ঠিকানায় পৌঁছে না। যাদের নৈতিকতা-মানবিকতা ধ্বংস হয়ে গেছে তারা তাদের পূর্বতনের ছায়া পেয়েছে এবং পরবর্তীদের জন্য অভিশাপ রেখে যাচ্ছে। আজকাল মন্দের দাপট এতো বেশি যে, ভালোর সাথে মন্দ মিশলে ভালোটিও রূপ-রঙ বদলে ফেলে। খুব কম ক্ষত্রেই ভালোর সাহচর্যে মন্দটিও সুন্দর হচ্ছে! জমানা পাল্টে গেছে! আমরাই পাল্টিয়েছি! তবে আশাব্যঞ্জক কিছুতে পরিবর্তন ঘটাতে পারিনি। এই ব্যর্থতার দায় আমাদের কম নয়। কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত এই সামগ্রিক পরিস্থিতিকে ফুটিয়ে তুলেছেন তার উটপাখি কবিতায়। কবির কবিতায়,
“আমি জানি এই ধ্বংসের দায়ভাগে
আমরা দুজনে সমান অংশীদার
অপরে পাওনা আদায় করেছে আগে,
আমাদের ‘পরে দেনা শোধবার ভার।”
যে বাবা-মা দুর্নীতির সাথে জড়িত, অবৈধভাবে অর্থ কামাই করে কিংবা অনৈতিক পন্থায় ক্ষমতাধর তাদের সন্তান কিশোর গ্যাঙয়ের লিডার হবে, নেশায় জর্জরিত হবে কিংবা মেয়েদের নিরাপত্তার হুমকি হবে- এটাই তো বরং স্বাভাবিক। বাবা-মায়ের চরিত্রের বৃহদাংশ সন্তানের কর্মকাণ্ডে পতিত হয়। আজ তরুণদেরকে বিপথে যাওয়ার জন্য সমাজকে দায়ী করা হচ্ছে, নেশার মচ্ছবে ছেলেমেয়েদের ধ্বংসের জন্য শঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে এবং চারিত্রিক অবনতির জন্য সময়কে দায়ী করা হচ্ছে! দায়টা আসলে কার? এই তরুণ-তরুণীদের বাবা-মায়েরা ক্ষমতার নামে, টাকা-কড়ি কামাইয়ের নামে কিংবা সেবা দেওয়ার নামে সমাজে কোন রীতি জাহির করেছে? কোন শ্রেণির পেশাজীবীদের সন্তান বেশি বিপথগামী সেই ক্লারিফিকেশনে যাচ্ছি না তবে একজন ভালো বাবা-মায়ের সন্তান মন্দ পথে হেঁটেছে এই দৃষ্টান্তও আছে তবে তা অতি নগণ্য। মন্দ লোকের সন্তানরাই মন্দ কাজের মধ্যে জীবনের ছন্দ খোঁজে! রক্ত এমন এক তরল যা পূর্ববর্তীর চলে যাওয়া সরলরেখা ও বক্ররেখাকে নিখুঁতভাবেই অনুসরণ করে।
যে মানুষের আয়ের সাথে অন্যের অধিকার হারানোর হাহাকার মিশ্রিত হয়েছে, যে লোকের পদচারণায় অন্যকেউ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কিংবা যে অন্যের বিশ্বাস হত্যা করে হেসেছে তার সন্তানের ওপর এসবের ছাপ-ছায়া থাকবে না- এটাও ভাবাও অবান্তর। যে খাদ্যে হারামের কণা মিশেছে, ভোগের যে সামগ্রীতে অন্যকে ঠকানোর অভিশাপ মিশেছে সেই রসে কষে বেড়ে ওঠা সন্তান অভিভাবকদের শান্তিতে রাখবে এটা ঘটলেই বরং ব্যতিক্রম হবে। পাপের সন্তান পাপের সাম্রাজ্যকে বিস্তৃত করবে। যে সন্তান বাবা-মায়ের ভন্ডামি দেখেছে, তাদের চারিত্রিক দ্বি-চারিতা থেকে শিখেছে তাদের সন্তান সুখের পালক হবে সে আশা দুরাশার। বরং দুরাচার অভিভাবকদের পাপ ছাপিয়ে গিয়ে সন্তান আরও অধিক গরল হবে। খারাবির এমন কোন শাখা-প্রশাখা থাকবে না যাতে সেই সন্তান বিস্তৃত হবে না। মদ, নারী এবং নেশায় জীবন জড়াবে। সুদ, ঘুষ এবং অনৈতিকতায় ডালপালা মেলবে। বাবা-মায়ের অবাধ্যতায় সমাজ-সংসার ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে রাখবে। নিজেরাও শান্তির দেখা পাবে না এবং বাব-মাকেও চির অশান্তিতে ডুবিয়ে মারবে।
ভালো বাবা-মায়েদের দোয়া সন্তানদের জন্য কল্যাণকামী। যারা অন্যায় করে না এবং বখে যাওয়া সময়ের সাথে মিতালি গড়ে না তাদের সন্তান সুসন্তান হয়। তারা অভাব থেকে শেখে। মানবিক হয় এবং সমাজ-সংসারের কল্যাণ সাধনে আপোষহীন রয়। সৎ-ন্যায়পরায়ণ দম্পতির ভোগের কথা জোড় দিয়ে বলার ক্ষেত্র থাকে না বটে, বিলাসিতার সাধ্য থাকে না মোটে কিংবা সম্পদের পাহাড় থাকে না ঘাটে ঘাটে কিন্তু তাদের প্রশান্তিময় ঐশ্বর্য থাকে, সন্তানদের নিয়ে গর্ব করার অবস্থান থাকে এবং দিনশেষে নীড়ে ফেরার ব্যাকুলতা থাকে। যে কখনো ঠকায় না সে স্থায়ীভাবে ঠকে না। চিরায়ত নিয়মে পৃথিবীর যাত্রায় দম্পতি রেখে যায় সন্তান। সেই সন্তান যদি আদর্শবান হয়, সমাজ ও সংসারের জন্য উপকারী হয় এবং মানুষ ও প্রাণীর জন্য নিরাপদ হয় তবে মহাকালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া পিতামাতার সঞ্চয়ের খাতায় অবিরাম-অবিরত পুণ্য জমতে থাকে। মানুষ গর্ব করে বলে, অমুকের ছেলে অমুক হয়েছে! বড্ড ভালো ছেলে, বাবা-মায়ের মত সৎ-সাধু হয়েছে- এই ক্ষণকালের জীবন যাত্রায় এর চেয়ে মহৎ প্রশংসা আর কিছুতে নাই। অর্জন পরিমাপের ক্ষুদ্রতম মানদন্ড সম্পদ, বৃহত্তর প্রশংসা
সুসন্তান গঠনের জন্য ভালো বাবা-মা হতে হবে। বাবা-মায়ের অনেক অর্থ-বিত্ত, ক্ষমতা-কর্তৃত্ব কিংবা খ্যাতি-সমাদর- এসবের সব বিফলে যাবে যদি সন্তান ভালোমানুষ না হয়। এক প্রজন্ম যা কিছু অর্জন করে তার অধিকাংশই সঞ্চয় করে রেখে যায় পরবর্তী প্রজন্মের নিরাপত্তা নিশ্চিতের আশায়। সেই অর্জন যদি পরের হক ঠকিয়ে হয়, কারো দীর্ঘশ্বাসের অভিশাপ লেগে থাকে কিংবা অবৈধ পথে হয় তবে সেই সম্পদ উত্তরাধিকারদের জন্য সুফল আনবে না বরং ধ্বংস প্রকট করতে রসদের ভূমিকা পালন করবে। উচ্ছনে যাওয়া, নষ্ট হওয়া সন্তানদের ঠিকুজি তালাশ করলেই দেখবেন সেখানে ভ্রষ্ট অভিভাবকদের ছাপ-ছায়া আছে। বিশ্বাস করুন আর না করুন, হারাম পন্থায় অর্জিত সম্পদে সংগৃহীত খাদ্য-কণায় যদি প্রজন্মের দেহে একফোঁটা রক্ত তৈরি করে তবে সেই একফোঁটাই শরীরের জন্য বিষবৎ।- ঐশ্বরিক ঘোষণা। সম্পদের পাহাড় দরকার নাই বরং পৃথিবী থেকে বিদায়ের আগে একটি সুসন্তান রেখে যান। সেই সন্তান জগত আলোকিত করবে এবং তার হিস্যা মাটির তলায় পৌঁছে যাবে। এমন সন্তান যোগের জন্য নিজের ভালো হওয়া জরুরি।
রাজু আহমেদ, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।
[email protected]
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।