All Menu

কালের পালে জিইয়ে নজরুল

১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট, বাংলায় ১২ই ভাদ্র ১৩৮৩ বঙ্গাব্দের সকাল ১০টা ১০ মিনিট । বাংলার আকাশ থেকে বিদায় নিলো আরও একটি নক্ষত্র । তাই চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করে এপ্রিল নয়, অভিশপ্ত মাস যদি বলতেই হয় তবে বাংলা দেশী-ভাষীদের জন্য সেটা অবশ্যই আগস্ট । বাংলাদেশের কবি, বাংলা ভাষার কবি গণ-মানুষের প্রিয় কাজী নজরুল ইসলাম । প্রেম-সাম্য-দ্রোহের প্রকাশে যিনি বাংলা ভাষা-ভাষীদের হৃদয় মন্দিরে যুগান্তর-জুড়ে বিরাজ করবেন স্ব-মহিমায়-স্ব-ভাস্বর হয়ে তিনি আর কেউ নন, আমাদের জাতীয় কবি, মহৎপ্রাণ কাজী নজরুল ইসলাম । তার প্রয়াণ দিবসে শোক গাঁথা লিখতে বসিনি । তার শুণ্যতার যে ক্ষতের কথা তিনি অমর সৃষ্টিতে গেঁথে গেছেন, ‘যেদিন আমি হারিয়ে যাব, বুঝবে সেদিন বুঝবে!/অস্তপারের সন্ধ্যাতারায় আমার খবর পুঁছবে-বুঝবে সেদিন বুঝবে।’-সেটুকুর উপলব্ধি করতে বসেছি মাত্র । কায়িক-ভাবে তার অস্তিত্ব নেই বটে কিন্তু মানবতার প্রতি পরতে পরতে, পরশে পরশে তিনি জড়িয়ে ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন সহস্রাব্দের পর সহস্রাব্দ ।

মা, মাটি ও মানুষের কবি হিসেবে তিনি সমাজের সকল অকল্যাণ, অন্যায়, অবিচারের বিরুদ্ধে অবিচল প্রচার চালিয়েছেন । অন্যায়ের সাথে কখনো আপোষ নয় বরং দ্বিধাহীন চিত্তে বলতে সাহস করেছেন, ‘আমি বেদুইন, আমি চেঙ্গিস,/আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্নিশ।/আমি বজ্র, আমি ঈশান-বিষাণে ওঙ্কার,/আমি ইসরাফিলের শিঙ্গার মহা-হুঙ্কার।’ শুধু দ্রোহ নয় তিনি ছিলেন প্রেমের মূর্ত প্রতীক । প্রেমের প্রকাশে রচিয়াছেন, ‘একে ঐ চাউনি বাঁকা/সুর্মা-আঁকা, তায় ডাগর আঁখি।/বাধিতে তায় কেন সাধ/যে মরেছে ঐ আঁখি-বাণে।’ । আজীবন তিনি মানবতা-সাম্যের কথা বলেছেন । কবির প্রতিবাদে, ‘কুলি বলে এক বাবু সা’ব তারে ঠেলে দিল নিচে ফেলে!/চোখ ফেটে এল জল,/এমনি করিয়া জগত জুড়িয়া মার খাবে কি দুর্বল?’ । আবার কবি আশার বানী শুনিয়ে বলেছেন, ‘আসিতেছে শুভদিন,/দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা, শুধিতে হইবে ঋণ!’ । কবির সৃষ্টিতে চমৎকারভাবে অঙ্কিত হয়েছে সমাজে মানবসৃষ্ট ঘৃণ্য বৈষম্যের চিত্র । যে সময়টাতে নারীরা অবহেলা, লাঞ্ছনা-গঞ্জনা নিয়ে সমাজে করুণভাবে উপেক্ষিত ছিল তখন তিনি বজ্রকন্ঠে উচ্চারণ করেছেন, ‘নর যদি রাখে নারীরে বন্দী, তবে এর পর যুগে/আপনারই রচা ঐ কারাগারে পুরুষ মরিবে ভুগে।/যুগের ধর্ম এই-/পীড়ন করিলে সে-পীড়ান এসে পীড়া দেবে তোমাকেই!’ ধর্মীয় কুসংস্কারের পাঁচিল ভাঙ্গার জন্য তিনি সর্বদা সচেষ্ট ছিলেন । তার বহু কবিতা-রচনায় এ ব্যাপারে অনেক দর্শন পাওয়া যায় । তার অমর সৃষ্টি, ‘মানুষ এনেছে গ্রন্থ;-গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনও!/আদম দাউদ ঈসা মূসা ইব্রাহিম মোহাম্মদ/কৃষ্ণ বুদ্ধ নানক কবীর,-বিশ্বের সম্পদ।/আমাদেরই এঁরা পিতামহ, এই আমাদের মাঝে/তাঁদেরই রক্ত কম-বেশি ক’রে প্রতি ধমনীতে রাজে।’

নজরুলে রচনায় ঘোড়ায় সাওয়ায় হয়ে অধ্যয়ন করা চলে না । তার রচনার প্রতিটি শব্দ, বাক্য বারবার পাঠ করে তার মর্মার্থ উপলব্ধি করতে হবে । বাংলাদেশের জাতীয় কবি হলেও দুর্ভাগ্যজনকভাবে আজ বাংলাদেশের মানুষের কাছ থেকে নজরুলকে বহুদূরে সরিয়ে রাখা হয়েছে । অশুভ শক্তির উত্থানে নজরুলের চর্চা কমে যাচ্ছে নিয়ত । নজরুলের সুরে তাল মিলিয়ে আমরাও বলতে চাই, ‘আর কতকাল থাকবি বেটি মাটির ঢেলার মূর্তি-আড়াল?/স্বর্গ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারী শক্তি চাঁড়াল।’ । সাম্যহীন, ভ্রাতৃত্ব-হীন এবং মানবতা-হীনতায় আমাদের চারপাশে আজ অশান্তির দাবানল জ্বলছে । অথচ নজরুলের আদর্শ-দর্শনকে যদি সাধারণ মানুষের কাছাকাছি ফিরিয়ে দেয়া যেত, তবে সকল মানুষ শান্তির পরশ পেত। নজরুলের কবিতাই আজ নজরুলকে জিইয়ে রাখছে । অশুভ শক্তির তীব্র আগ্রাসনের পরেও নজরুল তার স্ব-মহিমায় তাঁর ভক্ত-অনুরক্তদের হৃদয় মাঝে শ্রদ্ধা-সম্মানপূর্ণ স্থায়ী আসনে বসবাস করছে । তিনি যেমন বলেছেন, ‘মিথ্যা শুনিনি ভাই,/এই হৃদয়ের চেয়ে বড়ো কোনও মন্দির-কাবা নাই।’ তেমনি আমরাও বুকে হাত দিয়ে যেন বলতে পারি, আমাদের নজরুল আমাদের হৃদয়ে বেঁচে থাকবে আজন্মকাল ব্যাপিয়া । আজ নজরুলের শোকে স্মরণ-সভা হলেও মানবের হৃদয়ের মণিকোঠায় নজরুল কখনো অস্তমিত যাওয়ার ক্ষণজন্মা নয় । নজরুল মহাপ্রাণ । ভালোবাসার মুক্ত খাঁচায় আপনগুনে রাজ করবেন নজরুল । পাঠক-শ্রোতার ভালোবাসায় বেঁচে থাকবেন নজরুল ।
রাজু আহমেদ, প্রাবন্ধিক।
[email protected]

 

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top