।।এক।।
তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র জীবনের লক্ষ্যে বোকা হতে চেয়েছে। শুনে আমরা হেসেছি! সে কেন বোকা হতে চায়?-উত্তরে বলেছে বোকারা কাউকে ঠকায় না! এবার বোধহয় আমাদের বিস্মিত হতে হয়! ছোট্ট শিশু কী ভেবে, কতোখানি গভীর চিন্তা থেকে বোকা হতে চেয়েছে সে বিতর্ক থাক। স্বার্থের প্রশ্নে যারা বোকা হতে পেরেছে ওরা মহৎ। বোকা হতে পারলে স্বার্থ ভোলা যায়। যারা বোকা তারা ঠকে তবে ঠকাতে জানে না। এই অর্থে বোকা হওয়া খুবই পজিটিভ কিন্তু বেকুব হওয়া যাবে না। বোকা আর বেকুবের পার্থক্য যাতে গুলিয়ে না যায়!
যারা চতুর তারা অন্যকে ফতুর করে দিতে পারে। যারা লোক ঠকায়, যারা বিশ্বাস ভঙ্গ করে খায় কিংবা যারা প্রতিশ্রুতি বদলায় তাদের একজনও বোকা নয়। তারা ধূর্ত-চালাক। যারা নিজেদের স্বার্থ সবার আগে ভাবে, যারা নিজেদের ভাগ সবচেয়ে বড় রাখে কিংবা যারা নিজের জয়ের জন্য নীতি-নৈতিকতা ভুলে যা খুশি তাই করতে পারে তাদেরকে এই সমাজ বুদ্ধিমান ভাবে! যিনি পরের স্বার্থ-সুবিধা নিয়ে ভাবে, অপরের মঙ্গলের জন্য পরিশ্রম করে তাকে এই সমাজ বোকাই ভাবে! নিজের খেয়ে বনের মহিষ তাড়ানোকে কে আর সহজ চোখে দেখে! সেই শিশুটি ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার আগে মানুষ হোক। কৃষক হলেও নীতিবান হোক। সমাজের কথিত বোকা মানুষ হোক। যে অন্তত কাউকে ঠকাবে না।
অশিক্ষিত-শিক্ষিত নির্বিশেষে প্রতারকে চারপাশ ভরে গেছে। কে, কাকে ঠকাবে সেই উৎসবে মিছিল চলছে। খাই খাই স্লোগান জমছে! ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ, মজুদদার এবং অসাধু পেশাজীবী-ব্যবসায়ীতে সাধারণের জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। চতুরেরা অসাধারণে পরিগণিত হচ্ছে। কথায় ভেজাল, খাদ্যে ভেজাল এমনকি সুস্থ হওয়ার জন্য যে ওষুধ লাগে তাতেও ভেজালের ছড়াছড়ি। মানুষের মধ্যে ছল-চাতুরী এতো অধিক পরিমাণে বেড়েছে যে, ‘বিশ্বাস’ এখন অভিধানের শব্দ সর্বস্বতায় ঠেকেছে। সুতরাং সমাজে তেমন বোকাদের সংখ্যা বাড়ুক যারা ক্ষতির খতিয়ান বাড়াবে না বরং ক্ষতগুলোতে মলম মাখানোর কাজ করবে। অন্তত মিথ্যার বেসাতিতে স্বার্থ উঁচিয়ে থাকবে না।
।।দুই।।
সব পুড়ে গেছে যাক, আমার মাকে তো ফিরে পেয়েছি’-তাতেই আমি খুশি। অগ্নিকাণ্ডে সর্বস্ব হারানো পরিবারের আরেক অবুঝের মায়ের প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ এমনই ছিল। এটা শুনে আমরা বোধহয় আরেকবার থমকে দাঁড়িয়েছি। অথচ বাবা-মায়ের জন্য সন্তানের ভালোবাসা এমনই হওয়া স্বাভাবিক ছিল কিন্তু হয়নি। বাবা সম্পদের ভাগাভাগি করে যায়নি বলে আরেক প্রাপ্তবয়স্ক দামড়া সন্তান মৃত বাবার জন্য খনন করা কবরে শুয়ে পড়েছে! সম্পদের হিসাব না পেলে বাবাকে দাফন করতে দিবে না! এটাও তো এই সমাজের চিত্র! আমরা সন্তান হিসেবে সেই মা ভক্ত শিশুর মত হতে পারলে দুনিয়া বদলে যেতো। যদি শুধু মা-বাবা পাশে থাকলেই সন্তান খুশি থাকতো! -কতোখানি সুন্দর হতো সেই দৃশ্য!
সমাজের চালচিত্রের চোখে এই সন্তানেরাও বোকা। তবে জনতার বিচারে তারা বেকুব নয় বরং বীর! যে বাবা-মা ঈদের দিনেও নতুন কাপড় দেওয়ার সামর্থ্য রাখে না, বিশেষ দিনেও একটু গোশতের সংস্থান করতে পারে না অথচ ওরা কত ভালোবাসে বাবা-মা’কে। ওদিকে যারা চালাক-চতুর তারা বাবা-মায়ের সম্পত্তি নিয়ে, নিজেদের স্বার্থ ঘিরে খুনোখুনি বাঁধায় এবং কেস-মামলায় জড়ায়। অথচ বাবা-মা’কে দেখাশোনা করবে কে সেই জলসা মজলিসে গড়ায়! বৃদ্ধাশ্রম কিংবা অবহেলার আশ্রমে একাকীত্বে দু’জন অসহায় মানুষ দুঃসহ জীবন কাটায়। যাদের সমগ্র জীবন সন্তানের কল্যাণে ক্ষয়ে দিয়েছেন! অথচ সন্তান বোকা হলে এমন দুঃখ বাড়তো না। কোন অভিযোগ থাকতো না।
।।তিন।।
মমতা বাড়লে, ভালোবাসার ভিত মজবুত হলে এবং বিশ্বাস অটুট থাকলে মানুষ মানুষকে ঠকাতে পারে না। যার যার দায়িত্ব সে সে পালন করলে আমরা বাসযোগ্য নগরীর নাগরিক হতে পারতাম! তখন ভালো মানুষের সংকটে সভ্যতাকে ভুগতে-ধুঁকতে হতো না। মানুষ মানুষকে ঠকানোর আগে বিবেক বাঁধা হয়ে দাঁড়াত। আত্ম-কৈফিয়ত জাগ্রত হলে তবে কারো বোকা হওয়ার বাসনা আমাদেরকে বিস্মিত করতো না। আমরা মানুষ ডাক্তার, মানুষ আমলা এবং মানুষ শিক্ষক উপহার পেতাম! সবচেয়ে বড়কথা, সর্বত্রই আমার মানুষের আলো পেতাম। ভালো মানুষ ও সুসন্তান গড়ে না উঠলে সুখ স্থায়িত্ব পাবে না। মানবিকতা বেশিদিন টেকসই হবে না। যারা স্বার্থহীন সমাজ বিনির্মাণের চিন্তা করে তারা দলে দলে বোকা হোক। সমাজে চতুর বেকুব বয়কট-খেদাও আন্দোলন জোরদার হলে অনিয়ম-দুর্নীতি উদাও হবে। মানুষ হওয়ার দৌড়ে অবুঝ শিশুদের স্বপ্নগুলো পূরণ হোক। হবে তো?
রাজু আহমেদ। কলাম লেখক।
[email protected]
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।