All Menu

আরেকটু মানুষ হলে

প্রতিকি চিত্র।

মাঝারি সাইজের একটি হাতি শাবকের দিনে যে পরিমাণ খাবার দরকার ঠিক সেই পরিমাণ খাবার আমরা যোগাড় করি ইফতারিতে। মাত্র ১৪ ঘণ্টা উপোষেই যেন একেকটা রাক্ষস হয়ে গেছি। কারা যেন শুনিয়েছে, ‘ধর্মে আছে, রোজার মাসের ভক্ষণ-কৃত খাবারের কোন হিসাব দিতে হবে না!’ পকেটে হালাল-হারামের অঢেল অর্থ আছে, কাজেই বাহারি খাবারের পশরা সাজাতে তো দোষ নাই। কাকের মত এটা থেকে এক ঠোকর, ওটা থেকে আরেক ঠোকর, কোথাও এক চুমুক! ইফতারি শেষ। ভোজন শেষে যে বিপুলাংশ উদ্বৃত্ত থাকলো সেটার গন্তব্য ড্রেনে। যা জোগাড় করা হয়েছিল তার এক-দশমাংশও ভক্ষণ করার সাধ্য উপস্থিত জনতার ছিল না। চোখের ক্ষুধার চেয়ে পেটের ক্ষুধা খুব সামান্যই থাকে! শুধু নাম ফুটানো আর আভিজাত্য প্রকাশের জন্য এমন জমকালো আয়োজন। ভোজনের চেয়ে অপচয় ঢের!

এই চিত্রের ঠিক উল্টো বাস্তবতা পাশের বস্তিবাসীর! সেখানের মানুষগুলো সারাদিন পরিশ্রম করেও পরিবারের সবার ইফতারির জন্য দু’মুঠো শুকনো চিড়া আর এক মুঠো গুড় জোগাড় করতে পারেনি। সকাল বেলা বাসা থেকে বের হওয়ার সময় ৬ বছরের খুকিটি বাবার কাছে আবদার করে বলেছিল, বাবা! বিকালে আমার জন্য জিলাপি এনো। বাবাও তার কন্যাকে হাসিমুখে আশ্বাসও দিয়েছিলো। মহাজনের কাছ থেকে দুইশত বিশ টাকার বিনিময়ে রিকশা ভাড়া নিয়ে ৩০-৬০ টাকা করে ৪-৫টি খেপও মেরেছিল। স্বস্তির নিশ্বাস। অন্তত মহাজনের টাকাটা শোধ করার মত অবস্থা তো হয়েছে।

আরও কয়েকটি খেপ মারতে পারলেই আদরের দুলালীর জিলাপি, বউয়ের বায়না-কৃত একটু সদাই, রাতে রান্না করার জন্য চাল-সবজি ক্রয়ের টাকাটা হয়ে যাবে। মনে অনেক স্বপ্ন। দূর যাত্রার দু’জন প্যাসেঞ্জারও জুটেছিল। কিন্তু কপাল মন্দ। ঘণ্টা চারেকের জ্যামে আটকে সকল স্বপ্ন রাজপথেই ধূলিসাৎ হয়ে গেল। না জুটলো খুকির আবদারের জিলাপি, না রাতের রান্নার চাল। কোন মুখে দাঁড়ানো যাবে স্ত্রী-সন্তানের সামনে? এটা আমাদের সমাজের একাংশের চিত্র। দু’টো শ্রেণীতে বিশাল বৈষম্য। কোথাও কোথাও আয়ও মন্দ নয় কিন্তু বাজার দরের সাথে পাল্লা দিয়ে কুলিয়ে ওঠা মুশকিল!

শহরের মোড়ে মোড়ে অভিজাতদের বিশাল বিশাল জমকালো ইফতারির পার্টির আয়োজন। সেখানে বস্তির ছেলেগুলোর প্রবেশ নিষেধ। উদ্বৃত্ত খাবার কুকুরকে খাওয়াবে তবুও গরীবকে দেবে না। যদি ওরাও ভালো খাবারের স্বাদ বুঝে যায়! মসজিদে মসজিদে ইফতারির মহাসমারোহের আয়োজন, সেখানে ১২-১৪ বছরের ছিন্ন কাপড় পরিহিতরা উপস্থিত হলেই পিচাশ শ্রেণীর মানুষ ধমকে জিজ্ঞাসা করে, ব্যাটা রোজা রেখেছিস? সেখানের উদ্বৃত্ত খাবার ফেলে দেবে তবুও গরীবের কাছে দিবে না। খাবার পাওয়ার লোভে যদি ওরা প্রতিদিন আসে! রোজার মাসে বিভিন্ন রাষ্ট্র শত টন খাদ্য আমাদেরকে উপহার হিসেবে পাঠায়! সুষম বণ্টনে গলদ। বণ্টন করা হলেও, যাদের আছে তাদের ভাগ্যে আরও জোটে কিন্তু যাদের ঝুলিতে মোটেও নাই তাদের কপাল শূন্যই থাকে। মজুদের স্তূপ আরও উচ্চ করা হয়। পোকামাকড় খেয়ে নষ্ট করে, পঁচে যায় তবুও গরীবের ভাগ্যের শিকা ছেড়ে না!

কি মূল্য এই অভিজাত আয়োজনের? যেখানের গরীব সন্তান-সন্ততি নিয়ে ভুখা পেটে রাত কাটায় আর ধনাঢ্যরা লাখো টাকার খাদ্য নষ্ট করে কিন্তু গরীবকে ডেকে খাওয়ায় না। মানবিকতা না দেখালে সে ধর্মীয় আচরণ অন্তঃসার শূন্য! ইসলামের শিক্ষা, রোজার শিক্ষা, মানবতার শিক্ষা এমন? গরীব কাজ করবে এবং তার বিনিময়ে দেবো-এই মানসিকতা আমাদের রয়েছে কিন্তু তাদেরকে লিল্লাহিয়াত দান করবো-এমন মানসিকতা আমাদের মন কিংবা দেহের কোথাও নাই। কেন নাই, সে প্রশ্নের উত্তর অজ্ঞাত। আমরা কি ভয় পাচ্ছি, গরীবরাও ধনীদের সমকক্ষ হয়ে যাবে?

যে ইসলাম বৈষম্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে ধরার বুকে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল, সেই ইসলামের অনুসারীরা তথা মুসলিম হিসেবে আমরা বৈষম্য বর্ধিত করছি কোন নীতিমালায়? কৈফিয়ত কি দিতে হবে না? ইফতার পার্টি, অঢেল টাকা, আর পর্বত-সম আয়োজনের কোন মূল্য থাকবে না যদি আপনার সম্পদ দ্বারা গরীব উপকৃত না হয়। তাদের ক্ষুধার কষ্ট যদি না মেটে। মানুষ হিসেবে মানুষের প্রতি আমাদের দায়িত্ব যতটুকু তার কতটুকু আমরা পূরণ করেছি কিংবা করছি? তবে কি আজও আমরা মানুষ হতে পারিনি? ইস! যদি আরেকটু মানুষ হতাম!

আপনি তেমন দান করবেন কেন, যে দান করার বদৌলতে সুযোগ পেলেই আপনি মানুষকে খোঁটা দিবেন। গরীবের রক্ত চুষে কিংবা তাদের ব্যবহার করেই আজ সম্পদের পাহাড়। আপনার সম্পদের প্রতি অংশে গরীবের হক বা অধিকার আছে। একদিন পূরণ করতে হবে সে অধিকার-এটা সাম্যের দাবি, দাবি ভ্রাতৃত্ব ও মানবতার। মাজারে শিন্নী দেওয়ার লোক, অকাজে অর্থ বিনিয়োগের লোক সমাজের চারপাশে বহু আছে।

আপনি তাদের থেকে ভিন্ন হোন। আপনার একদিনের আয় ব্যয় করুন গরিব পিতার সন্তানের মুখে হাসি ফোঁটাতে। তাকে একবেলা আহার দিন, পারলে দু’খানা বই কিনে দিন। পান কিংবা বাদাম বিক্রি করার জন্য কয়েকটি টাকা মূলধন হিসেবে দিন। ইদের আগে আপনার সামর্থ্য অনুযায়ী একটুকরা কাপড় কিনে দিন। দেয়াটা আপনার দায়িত্ব। যদি উপেক্ষা করেন তবে আপনাকে বিবেক এবং বিবেকের স্রষ্টার কাছে কৈফিয়ত দিতে হবে। সেদিন আমাদের জন্য চরম লজ্জার দিন হবে। লৌকিকতা পরিহার করে গোপনে দানের মানসিকতা তৈরি করুণ। সৎকাজ বিনিময়-হীন যায় না।

রাজু আহমেদ। কলাম লেখক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top