কি ভয়ঙ্কর অনিশ্চয়তা নিয়ে মৃত্যু দুয়ারে দাঁড়ায়! অবসরে কত কত আনন্দ চলছিল, গল্প জমেছিল, প্রিয়জনের সাথে কাটানো ক্ষণ ছিল অথচ আগুনে জীবন ফুরিয়ে দিল। খাবারের অর্ধেক রয়েছিল তখনো, কারো কারো খাবার আসছিল, কেউ কেউ কেনাকাটা করছিল অথচ নিমিষেই জীবনের হিসাব বদলে গেল। জীবন বদলে গেলো লাশের সংখ্যায়। প্রতি চারবছর পরে দিনপঞ্জির পাতায় যে দিনটি আসে সেটিকে স্মৃতি-মধুর রাখতে অনেকেই এখন পূর্ণতম স্মৃতি! উৎসবে রাঙাতে গিয়ে প্রাণটাই মৃত্যুর রঙে মুড়িয়ে গেলো। কারো পরিবারের একজন সদস্যও অবশিষ্ট রইলো না যারা লাশের সামনে কাঁদবে! সবাই শেষ।
নিমিষেই কত কত স্বপ্নের অপমৃত্যু হল। মৃত্যু কখন, কাকে, কোথায় এবং কীভাবে ডেকে নেবে তা আন্দাজ করাও মুশকিল। মৃত্যুর ছায়া মায়ার মত আয়ুর পেছনে পেছনে ঘোরে! এখন পর্যন্ত যে ৪৬টি ফুল ঝরে গেছে পৃথিবীর বৃন্ত হতে তাদের কারোরই নিজ জীবনের ওপরে খুব বেশি অভিযোগ ছিল বলেও মনে হয় না। সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ছিল, প্রিয়জন-আনন্দ ছিল অথচ সুখ-সুধাটুকুন উপভোগের সময় মৃত্যুর হাতে ছিল না! বড্ড তাড়াহুড়ো করতেই হল। আরেকটি দুঃস্বপ্নের দীর্ঘ রাত কাটিয়ে বেদনার ভোর এলো।
গতানুগতিক-ভাবেই বেইলি রোডের দুর্ঘটনা কবলিত বিল্ডিংয়ে এখন রাজ্যের ত্রুটি পাওয়া যাবে। পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা ছিল না, সিঁড়ি চওড়া ছিল না, বিকল্প গমন ব্যবস্থা ছিল না কিংবা আইন অমান্য করে মওজুদ করা ছিল গ্যাস সিলিন্ডার-এরূপ বহু বহু কথা শুনতে হবে। এসব দেখার জন্য নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষ নিশ্চয়ই আছে। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন, ভুল স্বীকার ও শোকাহতের বার্তা এসব মৃত আত্মাকে কিঞ্চিত শান্তি দিতে পারে কিন্তু স্বজন-হারাদের বুকের পাথর কোনভাবেই নামবে না। যে ব্যথা বুকে চাপা পরেছে তা আর কোনভাবেই ক্ষইবে না।
মরণ ফাঁদের বাইরে আমরা কেউ নই! নিরাপত্তার আইন আছে কিন্তু সেসবের বাস্তবায়নে আছে ধীরগতি, পর্যবেক্ষণে আছে উদাসীনতা কিংবা অন্যকোন জালিয়াতি। নির্বিঘ্নে উদ্ধারকার্য চালাতেও জনতার হুজুগ বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। অপেশাদার সাংবাদিকদের মতামত ও জোরাজুরি বিপর্যয়কে আরও বাড়িয়ে তোলে। স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি দিন দিন অস্বাভাবিক পর্যায়ে পোঁছাচ্ছে। মৃত্যু যেখানে কেবল শতকিয়ার সংখ্যা সেখানে দায়িত্বে অবহেলা নৈমিত্তিক রুটিন। সাময়িক হা-হুতাশ করে আমরা মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছি। আরও বড় দুঃবাদ একদিন মৃত্যুর বেদনাও ভুলিয়ে দেবে।
যারা হারিয়েছে তারা স্বজন হারানোর মর্মবেদনা বোঝে। তাদের অন্তর পোড়ে। বিবেকের কাছে যতদিন ভিক্ষুকের জীবন আর ব্যবসায়ীর জীবন, গুরুত্বহীনের জীবন আর গুরুত্বপূর্ণের জীবন সমানভাবে মূল্যায়িত হবে না ততদিনে আমরা পূর্ণতম মানবিক সত্ত্বা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারবো না। মৃত্যুবরণকারীদেরকে আলাদা আলাদা মর্যাদায় আসীন করে স্পেসিফিক করার যে প্রবণতা তা লাশের মাঝে বৈষম্য বৃদ্ধি করে কি-না জানি না তবে জীবনের মূল্যের মাঝে পার্থক্যের দেয়াল টেনে দেয়!
অমুক প্রতিষ্ঠানে পড়ুয়ার জীবন, অমুকের জীবন কিংবা অমুকের আত্মীয়ের জীবন-এসব নিয়ে হাইপ তুললে সিকিউরিটি গার্ডের জীবন, ওয়েটারের জীবন তুচ্ছ হয়ে যায়। অভিজাত সাম্রাজ্যের কাছে এই ভেদ-রেখার আলাদা মূল্য থাকতে পারে কিন্তু যারা বিবেকবান হিসেবে নিজেদের দাবি করে তারা এই জাতীয় শব্দচয়ন করতেও পারে না। জীবিত মানুষকে সমানভাবে মূল্যায়ন করা না গেলেও অন্তত প্রাণহীন ধরগুলোকে সমান মর্যাদা দেয়া উচিত।
আমরা স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই। যে মানুষগুলো আগুনের ধোঁয়ার কারনে নিঃশ্বাস গ্রহণ করতে না পেরে মৃত্যুবরণ করেছে তাদের কষ্ট আমরা কখনোই বুঝবো না। যারা স্বজন হারিয়েছে তাদের মানসিক যন্ত্রণা বাইরের কারো উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। অনিরাপদ স্থানে মজুদ করা গ্যাস সিলিন্ডারে কি সাংঘাতিক মহামারি আনতে পারে তা দেশবাসী বিগত কয়েকটি অগ্নি-দুর্ঘটনাতে জেনেছে।
দুর্ঘটনার সংবাদ যখন আসতে শুরু করে তখন তা বিভিন্ন দিক থেকে আসে। ফেব্রুয়ারির শেষ রজনীতে রাজধানীর দুর্ঘটনার পর মার্চের প্রথম দিনে চট্টগ্রামের অগ্নিকান্ডের খবর এসেছে। সাবধান না হলে ক্ষতির খতিয়ান আরও দীর্ঘায়িত হবে। চলমান শুষ্ক হাওয়া অগ্নিকাণ্ডের ভয়াবহতা বাড়িয়ে দেবে। অসুস্থ হয়ে মারা যাওয়া, বার্ধক্যে উপনীত হয়ে মারা যাওয়ার আর কোন ধরণের অনাকিঙ্ক্ষত দুর্ঘটনা কবলিত হয়ে মারা যাওয়ার মধ্যে তফাৎ আছে। মৃত্যু অনিশ্চিত হলেও প্রক্রিয়াটি অস্বাভাবিক নয়। কাজেই নিরাপদে মৃত্যুর নিশ্চয়তা জরুরি।
প্রত্যেকটি দুর্ঘটনা কিংবা মৃত্যু আমাদের জন্য বার্তা রেখে যায়। জীবন বড্ড ক্ষণিকের, খুবই সংক্ষিপ্ত সময়ের। রঙ-তামাশা, ভোগ-বিলাস, দুর্নীতি এবং অন্যায়-অবিচারের মাঝে ডুবে যাওয়া ঠিক নয়। একদিন প্রত্যাবর্তন করতে হবে। লোভ যাতে মনুষ্যত্বকে দখল না করে-সজাগ থাকতে হবে। বিবেক যেন বেঁচে থাকে-চেষ্টা করতে হবে। রাষ্ট্রীয় আইন অমান্য করে ভবন নির্মাণ করলে, কাউকে অধিকার বঞ্চিত করে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার চেষ্টা করলে সে-ও চিরদিন বাঁচতে পারবে না।
স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তার জন্য রাষ্ট্র ও জনগণের যে সকল দায়িত্ব পালন করা দরকার সেগুলো সম্মিলিতভাবে পালিত হোক। অপঘাতে, দুর্ঘটনায় কিংবা অনাকাঙ্ক্ষিত একটি মৃত্যুও আমরা কামনা করি না। জীবন যাতে নিরাপদ হয়, উৎসব যাতে আনন্দের হয় এবং স্বজনসহ যাতে একসাথে বাঁচা যায় সেই বাসনা বারিত থাকুক। রাষ্ট্রের দলিলে প্রতিটি মৃত্যুর সন্তোষজনক কারণ থাকুক। আগুনে-পানিতে-মাটিতে মৃত্যুর পেছনে যথাযথ যুক্তি থাকুক। বেইলি রোডের দুর্ঘটনার মত এমন মরণ আমরা আর চাইছি না।
রাজু আহমেদ। প্রাবন্ধিক।
[email protected]
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।