All Menu

কে লিখেছে নাকি কি লিখেছে

প্রকাশে দ্বিধা নেই, বাঙালির সমাজে লেখক বাড়ছে জ্যামিতিক হারে অথচ পাঠক কমছে গাণিতিক হারে। অন্যদিকে আবার যাদের একটু পাঠাভ্যাস আছে তারা প্রতিষ্ঠিত ও জনপ্রিয় লেখকের বাইরে অখ্যাত লেখকদের লেখা পড়েন না বললেই চলে। অবশ্য এর যৌক্তিক কারণও আছে। ইতালীয় প্রবাদে প্রচলিত রয়েছে, ‘চিন্তা বেশি কর, কথা কম বলো এবং লেখ আরও কম।’ অথচ আমাদের সমাজে বেশিরভাগ লেখকরা যা জানেন তার চেয়ে লেখেন বেশি, বলেন তো আরও বহুগুণ বেশি। লেখকদের একাংশ নিজের বিজ্ঞাপনে যতোটা ব্যস্ততা, বহুরূপতা ও লজ্জাহীনতা দেখায় এমন রুচিহীন কাজ কপট ব্যবসায়ীও করতে লজ্জিত হন। যে কারনে শতাব্দী পেড়িয়ে গেলেও নতুন করে একজন রবীন্দ্রনাথ, নজরুল কিংবা মধুসূদনের দেখা মেলে না।

লেখকের শেখার পরিধি কেবল যে বইয়ের পৃষ্ঠায় আটকে থাকবে তেমনটা ভাবারও কারণ নাই। জাগতিক জীবন দর্শনের উপলব্ধি থেকে লেখকের জ্ঞান-ভাণ্ডার সমৃদ্ধ হয় বেশি। কল্পনার গভীরতা, দৃষ্টিভঙ্গির প্রসারতা, অনুভবের উৎকর্ষতা মূলত লেখকের প্রধান শক্তি। যদিও ইমারসন মনে করতেন, ‘শুধু প্রতিভা থাকলেই লেখক হওয়া যায়না, এজন্য বইয়ের সংস্পর্শেও থাকতে হবে।’ বিখ্যাত লেখক ড্রাইডেন মনে করতেন, ‘যে লেখক হতে ইচ্ছুক তার প্রথমে ছাত্র হওয়া উচিত।’ তবে ‘গট গিফটেড’ প্রতিভাধারী কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া আজ যারা লেখালেখির অঙ্গনে স্বনামধন্য, জনপ্রিয় ও বিখ্যাত তাদের লেখার চেয়ে অধ্যবসায়, পাঠাভ্যাস বেশি ছিলো। তারা যা জানতেন তার সারমর্ম প্রকাশ করতেন মাত্র। অথচ বর্তমানে লেখকরা ছিটেফোঁটা যা জানেন কিংবা একেবারেই যা না জানেন তাও রঙ চং মিশিয়ে আলো আঁধারিতে এমনভাবে প্রকাশ করেন যাতে তাদের লৌকিক-ভাবে ‘সবজান্তা শমশের’ মনে হয় অথচ ভাণ্ডের মালে বড়ে বড় সংকট! যেজন্য বর্তমানের কিংবা সমসাময়িককালের উল্লেখযোগ্য লেখকের পরিচিতি যুগের আবর্তেই হারিয়ে যাচ্ছে। তাদের প্রকাশিত চিন্তা গ্রহণের চেয়ে বর্জিত, আলোচিতের চেয়ে নিন্দিত হচ্ছে বেশি।

বাংলা ভাষা নিয়ে আমাদের গর্বের শেষ নাই। অবশ্য বাংলা ভাষার ইতিহাস, এর সমৃদ্ধি, মাতৃভাষা রক্ষার সংগ্রামে বাঙালি দামাল ছেলেদের তাজা খুন উৎসর্গ-এসব কারনে বাংলা ভাষা নিয়ে আমরা গর্ব করতেই পারি। তবে বাংলা ভাষার দুর্ভাগ্য যে, এ ভাষায় যারা সাহিত্য চর্চা করেছেন তাদের বেশিরভাগেই কালজয়ী সৃষ্টির পথে না হেঁটে ক্ষণকালের সস্তা জনপ্রিয়তা লাভের জন্য হাস্য-রসাত্মক গল্প, স্বল্প বসনার অশ্লীল কবিতা ও কৌতুক সৃষ্টিতে বেশি মনোযোগী হয়েছেন। অথচ এসবের সৃষ্টি ভাষাকে বিশ্বের বুকে সার্বজনীনতার মর্যাদা দেয়ার ক্ষমতা রাখে না। কালজয়ী সৃষ্টি-ই কেবল বিশ্বের বুকে ভাষার শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারে। যেপথে বাংলা ভাষাকে খুব বেশি হাঁটানো হয়নি। বাংলা ভাষায় সাহিত্য চর্চা-কারীদের লাখো লেখকের মধ্যে হাতেগোনা মাত্র কয়েকজন ছাড়া বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠত্ব বিশ্ব দরবারে তুলে ধরতে পারেননি। চিন্তা ও প্রকাশের ক্ষেত্রে এ আমাদের দৈণ্যতার প্রকাশ, ভাষার সঠিক প্রয়োগের অদক্ষতার করুণভাবে।

চলমান শতাব্দীতে যারা বাংলা ভাষায় সাহিত্য চর্চার সাথে যুক্ত তাদের সৃষ্টির বিষয়বস্তু নারী, ফুল, চাঁদ কিংবা বাঁশীর সুরের মোহাময়তায় আটকে আছে। অধিকাংশ লেখক তার ড্রয়িংরুম কিংবা লেখার রুমে বসেই সমাজ-মানুষের হাল-অঙ্কনের ব্যর্থ চেষ্টা করেছে। অবশ্য এসবে কেউ কেউ যে সাময়িক মর্যাদা পায়নি তাও বলার সাধ্য নাই তবে কালের আবর্তে হারিয়ে গেছে এসব লেখক ও তাদের সৃষ্টির শ্রেষ্ঠত্ব। লেখক কিংবা লেখা-কোনটাই পায়নি অমরতার স্বীকৃতি। বস্তির গিঁঞ্জিদশা, কৃষকের লাঙল-কাস্তে, দিনমজুরের হাল, বেশ-ভুষা ও শাসক-শাসিতের সম্পর্ক নিপুণভাবে ফুটিয়ে তোলার লেখকের বড় অভাব ঠেকছে বাংলা ভাষায়। বিদেশী সাহিত্যের নগ্ন নকল-করণ কিংবা পাইরেসির দ্বারা এদেশের অনেক লেখক হারিয়ে ফেলছে তাদের স্ব-প্রতিভা। বাংলা ভাষা-সাহিত্যের করেছেন অপূরণীয় ক্ষতি।

অর্থের ঝনঝনানি আর নির্মোহ সাহিত্যের চর্চা একই পথে চলতে পারেনা। সাহিত্যিকের মধ্যে যেমন ব্যথার অনুভূতি থাকতে হবে তেমনি ত্যাগের মহিমাও সমভাবে থাকবে। প্রেম-ভোগ যে থাকবে না তাও নয়। সাহিত্যাঙ্গনে আজ যারা অমরতার খেতাবে ভূষিত তাদের অনেকের জীবন পাঠে জানা যায়, তারা সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মালেও, ভোগের সবকিছু ত্যাগ করে মানুষের কষ্ট উপলব্ধি করেছেন, শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষায় হেঁটেছেন, গণমানুষের দুঃখ-দুর্দশার অংশীদার হয়ে কালির আছড়ে প্রসাব করেছেন সাহিত্যের সব কালজয়ী উপাখ্যান।

সব কিছুয়ের পরেও সকল লেখকের ওপর পাঠকের চর্চা থাকা উচিত। রম্য-রসের সাথে তত্ত্বের মিশ্রণ ঘটাতে না পারলে জ্ঞানের পূর্ণতা আসবে না কভু। একজন হুমায়ুনের সব লেখাই যে লেখক হুমায়ুনের মানগত হয়েছে-এমন ভাবার কারণ নাই। আবার অখ্যাত একজন লেখকের এমনও লেখা থাকে যা সময়ের আবর্তে বিশ্ব-সাহিত্যের অমূল্য সম্পদে পরিণত হয়। প্রারম্ভের নজরুল আর উপসংহারের নজরুলের মিল খুঁজে পেতে চাইলে তা ব্যর্থ প্রয়াস হিসেবে পরিগণিত হবে। সচেতন পাঠকের উদ্দেশ্য হচ্ছে সাহিত্যের রসাস্বাদনের মধ্য দিয়ে শিক্ষা গ্রহণ এবং উত্তম ও সফল জীবন গঠন করা। জীবনেরে যে স্তরে যাই পড়া হোক না কেন তার কোন অংশই বৃথা যায়না। শুধু নজরুল কিংবা রবীন্দ্রনাথ জানার মধ্যে পাঠাভ্যাসকে সীমাবদ্ধ রাখলে জীবন-জগতের অনেক অনুষঙ্গই অজানা থেকে যাবে হয়তো।

মুক্তো পেতে হলে সকল ঝিনুক গুলো যেমন খুলে দেখতে হয় তেমনি সাহিত্যের মুক্তো ভোগের জন্য সকল লেখকের সৃষ্টি সম্পর্কে ধারণা থাকা জরুরী না হলেও অনাবশ্যক নয়। কাজেই পাঠের ক্ষেত্রে লেখকের প্রধান্য দেয়া একেবারে-ই দোষীয় নয় তবে কে লিখেছে তার চেয়ে কি লিখেছে তা উপলব্ধি করাটা বেশি জরুরী বোধহয়। সব কথার পড়েও স্যামুয়েল জনসনের সেই বিখ্যাত উদ্ধৃতি দিয়ে শেষ করবো যেখানে তিনি বলেছেন, ‘যার যে বই পড়তে ভালো লাগে, তাই-ই তার পড়া উচিত, কেননা; বাধ্যতামূলকভাবে বা শেখার আগ্রহ নিয়ে বেছে বই পড়তে পড়তে প্রকৃত কাজ হয় সামান্যই। মোটকথা, আমাদের প্রচুর পাঠাভ্যাস গড়ে তোলা উচিত। লেখক কিংবা পাঠক-সকলের-ই প্রথমে এবং সর্বতোভাবে একনিষ্ঠ পাঠক হওয়া আবশ্যক। জাগতিক সকল ঝঞ্ঝাট থেকে মুক্তির উপায় হচ্ছে, বেশি বেশি বই পড়া। যতবেশি পড়বেন, ততবেশি জানবেন। যারা বইয়ের সাথে কথা বলেন তাদের শত্রু থাকে না।

রাজু আহমেদ। প্রাবন্ধিক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top