বাংলাদেশের ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ শিক্ষাক্রম পেয়েছে রাষ্ট্র। ’৯০ দশকের অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, তোতা পাখির মত মুখস্থ বিদ্যা, এই শতকের সৃজনশীলের ত্রুটি-বিচ্যুতি কাটিয়ে যে মূল্যায়ণধর্মী এবং সমস্যার সমাধান-কারক নতুন শিক্ষাক্রম চালু করেছে সরকার সেটা একদিকে যেমন যুগোপযোগী, উন্নত বিশ্বের সাথে প্রতিযোগিতামূলক এবং শিক্ষার্থীদেরকে দক্ষতা-ভিত্তিক জ্ঞান অর্জনের সহায়ক পদ্ধতি। তবে এই চমৎকার শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের বাধা প্রধানত একটি। যারা এই নতুন পদ্ধতি মাঠ-পর্যায়ে তথা প্রতিষ্ঠানে বাস্তবায়ন করবে সেই সম্মানিত শিক্ষকগণ পুরোপুরি প্রস্তুত কি-না? কেন এই প্রশ্ন? শিক্ষকদেরকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি, সামাজিক অবস্থান, বাজারমূল্যের সাথে বেতনের অসামঞ্জস্য, চাকুরির সুযোগ-সুবিধা এসব বিবেচনায় বর্তমানে শিক্ষকদের সিংহভাগ অসুখী এবং অখুশি। রাষ্ট্রে এখনো তৃতীয় শ্রেণির পদমর্যাদার শিক্ষক আছে! মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরের শিক্ষকদের নিয়মিত পদোন্নতি না হওয়া, টাইম-স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড সংক্রান্ত জটিলতা, শিক্ষকদের কিছু পদ অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তাদের অধিগ্রহণে যাওয়া, অধ্যাপক পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের দীর্ঘ-বছর ইনক্রিমেন্ট না হওয়া-এই জাতীয় নানাবিধ বঞ্চনা শিক্ষকদের মানসিকভাবে মুষড়ে দিয়েছে। শিক্ষকদের সাথে আলাপকালে অনুধাবন করা যায়, বঞ্চনার প্রলম্বিত ইতিহাসে কতোখানি ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে!
রাষ্ট্র যাদের নিয়ে এবং যাদেরকে দিয়ে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করতে চায় তাদেরকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও প্রাপ্য অধিকারের জায়গাতে বঞ্চিত করে বিপুল সম্ভাবনাময়ী নতুন শিক্ষা কাঠামোকে বাস্তবায়িত করতে পারবে?-সেটা তুমুল বিতর্কের অবকাশ রাখে! রাষ্ট্র শিক্ষাক্ষেত্রে অবকাঠামোগত ব্যাপক উন্নয়ন করতে পারে কিন্তু শিক্ষকদেরকে যদি সন্তুষ্ট করতে ব্যর্থ হয় তবে নির্দিষ্ট লক্ষে পৌঁছানো সম্ভব হবে না। সম্প্রতি বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারে কর্মরত প্রভাষকদের একাংশের সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি হয়েছে! এখানে লক্ষ্যনীয় যে, প্রভাষক পদে একজন ক্যাডার কর্মকর্তা ১০ বছর কর্মরত আছে অথচ বেশ কয়েকবছর পরে পদোন্নতির প্রজ্ঞাপন প্রকাশিত হলেও তাতে অনেকের নাম আসেনি! আশানুরূপ হয়নি তো বটেই! এই বঞ্চনা কেবল পদোন্নতি বঞ্চিতদেরকে হতাশ করেনি বরং তাদের সকল জুনিয়র ব্যাচের মধ্যে হতাশা ছড়িয়েছে। জড়িয়েছে মানসিক জড়ায়! বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ গ্রহণ, বিভাগীয় পরীক্ষা ও সিনিয়র স্কেল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ এবং সন্তোষজনক এসিআর থাকার পরেও যারা দীর্ঘ অপেক্ষার পরেও পদোন্নতি পানি তারা মানসিক তুষ্টি নিয়ে নবোদ্যমে ক্লাসরুমের ডায়াসে শিক্ষার্থীদের সামনে দাঁড়াতে পারবে-এমন আশা কি রাষ্ট্র করে? করা কি উচিত?
অন্যান্য ক্যাডারে কর্মরত কর্মকর্তাদের নবম গ্রেড থেকে ষষ্ঠ গ্রেডে পদোন্নতি পেতে নির্ধারিত সময়ের ছয়মাস থেকে বড়জোর এক বছর অপেক্ষা করা লাগতে পারে! ক্ষেত্র-বিশেষে সামান্য ব্যতিক্রম আছে হয়তো! কিছু কিছু ক্যাডারে কর্মরতদের নির্ধারিত সমেয়ই পদোন্নতি হয়! অথচ শিক্ষা ক্যাডারে কর্মরতদের প্রথম পদোন্নতি হতে যুগের অপেক্ষা করতে হয়! মানুষ তো মেশিন নয় যে সে অনুভূতিহীন টিকে থাকবে! এই প্রবঞ্চনায় তাকে ভূপাতিত করে! একই রাষ্ট্রব্যবস্থায় এমন দ্বিমুখী নীতি কোনভাবেই ভালো ফলাফল আনয়ন করবে না। মনিটরিং করে, শাসিয়ে, শাস্তির ভয় দেখিয়ে উপস্থিতি নিশ্চিত করা যায় কিন্তু সুচারুভাবে দায়িত্বপালনের জন্য বলবর্ধক প্রদানের মাধ্যমে নিয়মিত প্রেষণাও দিতে হবে। কর্মকালে পুরস্কার-পদোন্নতি এসব টনিকের কাজ করে! এমন সুন্দর শিক্ষাক্রমকে বাস্তবায়িত করতে হলে, আকাঙ্ক্ষিত ফলাফল লাভ করতে হলে বাংলাদেশকে পার্শ্ববর্তী দেশ-গুলোসহ পশ্চিমা বিভিন্ন দেশে শিক্ষকদেরকে প্রদত্ত নাগরিক সুযোগ-সুবিধা, আর্থিক নিরাপত্তা ও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির দিকে নজর দিতে হবে। সম্মানের ক্ষেত্রে নিয়ে নতুনভাবে ভাবতে হবে। যেহেতু এই শিক্ষাক্রম উন্নত বিশ্বের শিক্ষাক্রমের সাথে সাযুজ্য সেহেতু শিক্ষকদেরকেও আন্তর্জাতিকতার অনুরূপ সুযোগ সুবিধা দিতে হবে। গবেষণার ক্ষেত্রকে উন্মুক্ত করতে হবে। একথা বলতে দ্বিধা নাই, পেটে ক্ষুধা নিয়ে যে শিক্ষক শিক্ষার্থীদের সামনে দাঁড়ায় সেই শিক্ষক যতই মহান শিক্ষক হোন, সে তাঁর শিক্ষার্থীদের বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখাতে পারেন না। যেই শিক্ষক তার প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে মনমরা অবস্থায় শিক্ষার্থীদের মুখোমুখি হন সেই শিক্ষক শিক্ষার্থীদের মেরুদণ্ড সোজা রাখার শিক্ষা দিতে পারেন না! নিশ্চয়ই একদিন বাংলাদেশ বহুদূরে যাবে তবে শিক্ষকদেরকে সই যাত্রায় চালকের ভূমিকা দিলে যাত্রাটি সহজ হবে।
যদিও শিক্ষাবিদদের একাংশ মনে করেন, কোন রাষ্ট্রের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা থেকে সম্পূর্ণ পরিবর্তনের মাধ্যমে নতুন ব্যবস্থায় যাওয়া ঠিক নয় তবুও আমরা আশাবাদী বর্তমান সরকারের শিক্ষা-বান্ধব মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, সুদক্ষ ও শিক্ষক-সুহৃদ মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর দক্ষ পরিচালনায় নতুন শিক্ষাক্রম এ দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় বিপ্লব সূচিত করবে। শিক্ষাকে এগিয়ে নিতে নতুন মেগাপ্রজক্ট হবে-এমন আশাবাদ পেয়েছি। একটি নতুন পদ্ধতি হিসেবে পাঠ্যবইয়ে কিছু কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকতে পারে, সারাদেশের শিক্ষকদেরকে দক্ষ করে গড়ে তুলতে প্রশিক্ষণের জন্য আরও কিছু সময় লাগতে পারে, অভিভাবকদের শিক্ষাক্রম নিয়ে ভুল ধারণা দূর হতে আরও কিছু সময় অপেক্ষা করতে হতে পারে তবে এই শিক্ষাক্রম আদর্শ জাতি গঠনের সহায়ক হবে। তবে শিক্ষকদের স্বার্থ নিয়েও রাষ্ট্রকে চিন্তা-ভাবনা করতে হবে। এদেশের সকল শিক্ষক আদর্শ শিক্ষক, নীতিবান সাধু-এই দাবী করার কোন সুযোগ নাই। তবে শিক্ষকদের মধ্যে ভালোর সংখ্যা অন্যান্য পেশাজীবীদের তুলনায় অনেক বেশি। অনেক বেশি। কাজেই সৎ শিক্ষকগণ যাতে সম্মানের সাথে পরিবার নিয়ে সমাজে বাঁচতে পারে সেই ব্যবস্থা রাষ্ট্র নিশ্চয়ই করবে। প্রাথমিকের শিক্ষকদেরকে এখনো তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী হিসেবে রাখা হয়েছে। যেটা জাতি হিসেবে আমাদের জন্য কিছুটা লজ্জারও। যারা জাতির ভিত রচনা করেন তাদেরকে উপযুক্ত সম্মান না দিলে আত্মনির্ভরশীল প্রজন্ম গড়ে তোলা মুশকিল।
সকল সীমাবদ্ধতার মধ্যেও আমরা আশাবাদী। একদিন সব আক্ষেপ ঘুচবে। তবে কর্তৃপক্ষের সদয় পদক্ষেপে যেসকল বঞ্চনা দূরীকরণের সক্ষমতা রাষ্ট্রের রয়েছে সেগুলো আশু উদ্যোগের মাধ্যমে সমাধান করা উচিত। শিক্ষা ও শিক্ষা সংশ্লিষ্ট যে-সকল স্থানে দুর্নীতি বাসা বেঁধেছে সেগুলো চিহ্নিত করে অচিরেই কর্তৃপক্ষকে শুদ্ধি অভিযান পরিচালিত করতে হবে এবং অন্যায়-অনাচার নির্মূল করতে হবে। আমরা চাই, এমন এক প্রজন্ম গড়ে উঠুক যারা কেবল সনদ-ধারী শিক্ষিত হবে না বরং মানবিক মানুষ হিসেবে গড়ে উঠবে। দুর্নীতিকে ঘৃণা করবে। অধিকারহীনের পক্ষে লড়াই করবে। সর্বোপরি দেশ গঠনে সরাসরি অংশগ্রহণের যোগ্যতা নিয়ে বেড়ে উঠবে। যারা নিজেরাই স্বপ্ন দেখতে এবং সে স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার সক্ষমতা অর্জন করবে। আশা করি, নতুন শিক্ষাক্রম শিক্ষার্থীদের সেই পথে পরিচালিত করবে যদি শিক্ষকগণ সমাজে সম্মান-মর্যাদা নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর নিশ্চয়তা পায়।
রাজু আহমেদ। কলাম লেখক।
[email protected]
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।