All Menu

উপহারে বইয়ের প্রচলন চিন্তার বাঁক বদল ঘটাতে পারে

এমন যদি হতো, দুর্নীতিবাজরা বিদেশে বই পাচার করছে, ঘুষখোররা ঘুষ হিসেবে বই চেয়ে নিচ্ছে। স্বামীর কাছে স্ত্রী’র বায়না বই। স্কুল-কলেজগুলো পুরস্কার হিসেবে থালা-বাটির বদলে শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দিচ্ছে। বিয়ে-আকিকা-সুন্নতে খৎনায় উপহারের প্যাকেটে বই। আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার পথে গৃহস্থের জন্য দু’খানা বই নিয়ে যাওয়া। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর হাতে বই শোভা পাবে! বাবা তার সন্তানদেরকে বিভিন্ন উপলক্ষ্যে বই উপহার দিচ্ছে। প্রিয়জন গোলাপের বদলে বই চেয়ে নিবে !-তবে কেমন হতো?

এতক্ষণ স্বপ্নের কথা বললাম। কিছু স্বপ্ন তো ঘুম ভাঙার আগেই ভেঙে যায়। বই সম্পর্কে উল্লেখিত সব আশা পূরণ না হলেও কিছু কিছু আশাবাদ অবাস্তব নয়। জৌলুস হারানো প্রকাশনা শিল্পকে জাগিয়ে তুলতে, মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন প্রজন্ম গড়ে তুলতে বইয়ের বিকল্প নাই। অন্তত এদেশের লাখ লাখ স্কুল কলেজ তাদের বিভিন্ন আয়োজনে বিজয়ীদেরকে বই উপহার দিতে পারে। কর্তৃপক্ষের সামান্য সদিচ্ছাতেই এই চাওয়া পূরণ হতে পারে। উপহারে বই দেওয়ার প্রচলন করা গেলে সেটা সমাজব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন ঘটাবে।

বছর-ঘুরে একুশের বইমেলা দুয়ারে দাঁড়িয়েছে। ফেব্রুয়ারি জুড়ে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে লাখ লাখ পাঠকের পাদচারণায় মুখরিত হবে। হাজার হাজার নতুন বইয়ের ঘোমটা উন্মোচিত হবে। লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে কতশত অচেনা মুখ। কেউ কেউ দেশ বিখ্যাত হবে। প্রকাশনা শিল্প বছরের ঘাটতি কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখে। কিন্তু বই যা বিক্রি হয় তারচেয়ে ফুচকা কম বিক্রি হয় না!-এমনও অভিযোগ আছে! বই নিয়ে আলোচনা যা হয় তারচেয়ে বান্ধবী বিতর্ক বেশি জমে!

যে ঘরে বই আছে সে ঘর প্রশান্তির । যারা বই পড়ে তারা অনেক ধরণের অপরাধ থেকে নিজেদেরকে বাঁচিয়ে রাখতে বাধ্য হয়। যে প্রজন্মের হাতে বই আছে সেই প্রজন্ম পথ হারাবে না। দুঃখজনক হলেও সত্য, শিক্ষার্থীরা বই বলতে এখন ক্লাসের গাইড বইকে চেনে। শিক্ষকগণ পাঠের অভ্যাস হারাচ্ছেন। সাধারণ মানুষদের পাঠের চিত্র বেহাল। শহরের বহুল পরিচিত লাইব্রেরিগুলো উঠে যাচ্ছে। সেসব স্থানে শীততাপ নিয়ন্ত্রিত জুতার দোকান খুলছে। উপজেলা-জেলা পর্যায়ের লাইব্রেরিতে মানসম্মত বই নাই। পাঠক না থাকলে ব্যবসায়ীরা বই কিনে তো আর ঘুনেপোকার খাদ্য করবেন না!-দাবি যৌক্তিক!

দুঃখজনক হলেও সত্য, ফেসবুকের জনপ্রিয় লেখকরাই আজকাল বেস্ট সেলার! বিভিন্ন অঙ্গনের জনপ্রিয় তারকাদের বই হরদম চলছে! এছাড়াও মাত্র কয়েকজন লেখকের বইয়ের বেশ কাটতি হলেও অন্যান্য লেখক-প্রকাশক ঘাটতিতে পড়ছে। জ্ঞান পিয়াসুদের বৃহত্তর মিলন-মেলায় ভাষার মাসে বই নিয়ে যেভাবে আলোচনা থাকে, বছরের বাকি সময়টাতে বই নিয়ে উচ্ছ্বাসের ঘাটতি দেখা যায়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বিশেষ করে ফেসবুক মানুষকে অতি পণ্ডিত বানিয়েছে! যাতে দিন দিন মানুষের পাঠাভ্যাসে ভাটি পড়ছে। মানুষ কেন যেন পড়তেই চায় না। পড়ার অভিনয় করে তাও পড়ে না। যা পড়ে তাও মানে না!

পাঠের বিকল্প এখনো কিছু পাওয়া যায়নি। বই হাতে নিয়ে পাঠের যে আনন্দ তা ভার্চুয়ালি কোন মাধ্যমে সৃষ্টি হয় না তাছাড়াও যারা নিয়মিত বই ক্রয় করেন তাদেরও অন্যান্য খাতেরও অপচয় হ্রাস পায়। বই কিনে যদি বাসায় স্তূপ করেও রাখা হয় তাতেও পরবর্তী প্রজন্ম উপকৃত হবে। প্রজন্মের হাতে যদি বই তুলে না দেওয়া হয় তবে তারা মাদকে আসক্ত হবে, নেশায় বুঁদ হবে, মন্দ সঙ্গে নষ্ট হবে। সবচেয়ে বড় কথা, বইয়ের স্পর্শহীন প্রজন্ম বেয়াদব হিসেবে গড়ে উঠবে। যেজন্য লাইব্রেরি কেন্দ্রিক আন্দোলন গড়ে ওঠা দরকার। বইয়ের শিক্ষা মানুষকে অপরাধ থেকে ফিরিয়ে রাখতে সাহায্য করে। বই যাদের নিত্যসঙ্গী তাদের শত্রু কম। অভাব-সীমাবদ্ধতার মাঝেও ভুবন সৃষ্টি করে তারা জাগতিক দুঃখ-অকল্যাণ থেকে নিজেদেরকে বিরত রাখতে পারে। বইয়ের কালো অক্ষরের প্রভাব জীবনের জন্য বড্ড জরুরী। ভবিষ্যতের সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য অতীতের মানুষদের সম্পর্কে, তাদের চিন্তা-চেতনা সম্বন্ধে জানতে হবে।

এতো পড়ে হবে কি?-প্রায়ই পড়ুয়াদের এই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। আর কিছু না হোক, উত্তরে অন্তত একটুকু বলা যায়, বই পড়লে কেউ এমন আহাম্মক প্রশ্ন করতে পারে না! পড়ুয়াদের মাথায় এমন প্রশ্ন আসে না! বইমেলা থেকে অন্তত কিছু বই কিনুন। রাজধানী থেকে দূরে থাকলেও একবার বইমেলায় ঘুরে আসুন। বইয়ের মলাট ছুঁয়ে দেখার মাঝেও হৃদয়কে প্রশান্ত করার মলম আছে। ফেব্রুয়ারিতে কিছু বই কিনুন। এছাড়াও প্রতিমাসে একখানা করে কিতাব খরিদ করলেও জীবন সায়াহ্নে আপনি হাজার বইয়ের মালিক থাকবেন। যে বইয়ের পৃষ্ঠায় আপনার স্পর্শ থাকবে, আন্ডার-লাইন করা থাকবে, মন্তব্য থাকবে। আপনার উত্তরসূরীরা যদি সে বই ফেরিওয়ালাদের কাছে বিক্রি করেও দেয় তবুও দূর দেশের অচেনা একজন মানুষ আপনার স্পর্শের উপস্থিতি উপলব্ধি করবে!

মানসম্মত বইয়ের প্রকাশনা বাড়াতে হবে। এ কথা বলা অত্যুক্তি হবে না যে, কোনটা বই আর কোনটা আবর্জনা সেটার যাচাই-বাছাই করতে করতে পাঠাভ্যাস মরে যায়। প্রতিবছর লাখ লাখ নতুন বই প্রকাশিত হচ্ছে অথচ জ্ঞানের খোরাক আছে, চিন্তাকে ধাক্কা দেয়ার রসদ আছে মনের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করার ক্ষমতা আছে এমন বইয়ের সংখ্যা যত-সামান্যই। কেউ কেউ শখের বসে, নামের বিজ্ঞাপন দিতে এমন এমন হাস্যকর ময়লা-আবর্জনা প্রকাশ করে যা সমঝদার পাঠকের বমনের উদ্রেক ঘটায়। যে কারনে এক বছরের বইমেলায় যে বই নিয়ে হইচই, লেখকের সামনে লাইন, পরের সিজনে সেই লেখক ও লেখা হারিয়ে যায়। আবার ধান্ধা-বাজ শ্রেণি বইয়ের এমন চটকদার বিজ্ঞাপন মানুষের কাছে পরিবেশন করে যার কারনে সে বই কিনে পাঠক বই কেনার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। সেজন্য বইয়ের বিপণন ব্যবস্থায় ধাক্কা দিতে হবে। শখের লেখকদের পাণ্ডুলিপি জ্ঞানধর প্রকাশকের কাছ থেকে বাছাই পরীক্ষায় উৎরে যাওয়ার সক্ষমতা থাকতে হবে।

বই না পড়লে মানুষের সুপ্ত প্রতিভা বিকশিত হয় না। বিভিন্ন পরিবেশ ও পরিস্থিতির সাথে খাপ-খাওয়ানোর সূত্র জানতে পারে না। বই যদি নিত্যদিনের সঙ্গী হয়ে তবে নিশ্চিতভাবে আপনার অপরাধ এবং পাপ কমে আসবে। আড়ালে মানুষের চর্চা ভুলে যাবেন। মানুষকে মূল্যায়ন করতে শেখাবে এবং অন্যের অধিকার ফিরিয়ে দিতে বোধ তাড়না দিবে। ফেব্রুয়ারিতে আপনার সংগ্রহে কয়েকখানা নতুন বই আসুক। যে সময়কে অপচয় করছেন সেই সময়ের কিছু অংশ কালো অক্ষরের সোনালি কথামালা পড়ুন। নিজেকে জানুন, অপরকেও চিনুন।

রাজু আহমেদ।
পাঠক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top