মৌলিক চাহিদা পূরণের পাশাপাশি ভালোভাবে জীবন চালানোর জন্য প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক মানুষকে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ ও সঠিক তথ্য জানা-বোঝা প্রয়োজন। এই বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ ও সঠিক তথ্য জানানোর গুরুদায়িত্ব পালন করেন সাংবাদিকগণ। স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলা হয়। আর সাংবাদিকগণ হলেন এই চতুর্থ স্তম্ভের পরিচালক।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাংবাদিকদের জীবনযাত্রা ও পেশাগত মান উন্নয়নের লক্ষ্যে বেশ কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই ১৯৭৪ সালে ‘সংবাদপত্র কর্মচারী (চাকরির শর্তাবলি) আইন, ১৯৭৪’ প্রণয়নের মাধ্যমে সাংবাদিকদের অধিকার ও মর্যাদাকে রাষ্ট্রীয় আইন দ্বারা সুরক্ষিত করা হয়।
সরকার সাংবাদিকদের কল্যাণে বহুমুখী উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। সাংবাদিকদের আর্থিক সহযোগিতা প্রদানের লক্ষ্যে ‘বাংলাদেশ সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্ট আইন, ২০১৪’ প্রণয়ন করা হয়েছে। ২০১৪ সালের ৮ই জুলাই বাংলাদেশ সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠা করা হয়। ২০১৬ সালের ১৩ই এপ্রিল বাংলাদেশ সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্ট বিধিমালা গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশ সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্ট ১৩ সদস্য-বিশিষ্ট একটি ট্রাস্টি বোর্ডের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সচিব, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিবৃন্দ, সাংবাদিক ইউনিয়ন এবং সরকার কর্তৃক মনোনীত বিশিষ্ট সাংবাদিকদের সমন্বয়ে এই ট্রাস্টি বোর্ড গঠিত। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী পদাধিকার বলে ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সচিব পদাধিকার বলে ভাইস চেয়ারম্যান এবং সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদাধিকার বলে সদস্য-সচিব।
বাংলাদেশ সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্টের কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে— দুস্থ ও অসচ্ছল সাংবাদিকদের কল্যাণ সাধন; পেশাগত কাজে অক্ষম ও অসমর্থ সাংবাদিককে আর্থিক সাহায্য প্রদান; অসুস্থ সাংবাদিকদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা বা আর্থিক সাহায্য প্রদান; সাংবাদিকতায় বিশেষ অবদানের জন্য বৃত্তি প্রদানের ব্যবস্থা করা; সাংবাদিকদের মেধাবী সন্তানদের শিক্ষার জন্য এককালীন মঞ্জুরি, বৃত্তি কিংবা স্টাইপেন্ড প্রদান; দুর্ঘটনায় বা দায়িত্ব পালনকালে কোনো সাংবাদিক গুরুতর আহত হলে তাঁকে বা তাঁর মৃত্যু ঘটলে তাঁর পরিবারকে সাহায্য প্রদান; ট্রাস্টের তহবিলের জন্য অর্থ সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও বিনিয়োগ এবং অবসরপ্রাপ্ত প্রথিতযশা দুস্থ সাংবাদিক অথবা প্রথিতযশা প্রয়াত সাংবাদিকদের অসচ্ছল পরিবারের সদস্যদের আর্থিক সহায়তা প্রদান ও তাঁদের কল্যাণ সাধন।
বাংলাদেশ সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠার পূর্বে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রণীত নীতিমালার অধীন সাংবাদিকদের আর্থিক অনুদান প্রদান করা হতো। ২০১১ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ৬২৩ জন সাংবাদিক ও তাঁদের পরিবারকে মোট ৩ কোটি ৮০ লাখ টাকা আর্থিক অনুদান প্রদান করা হয়। ২০১৫-২০১৬ অর্থবছর থেকে সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্ট সাংবাদিকদের আর্থিক সহায়তা প্রদান শুরু করে। ২০১৫-২০১৬ অর্থবছর থেকে ২০২২-২০২৩ অর্থবছর পর্যন্ত কল্যাণ অনুদান হিসাবে মোট ২৯ কোটি ৮১ লাখ ৫০ হাজার টাকা ৩ হাজার ৪৩৩ জন সাংবাদিক ও সাংবাদিক পরিবারের মাঝে বিতরণ করা হয়।
২০২০ সালে সারা দেশে কোভিড-১৯ ভাইরাস ছড়িয়ে পড়লে অন্যান্য পেশার লোকদের মতো সাংবাদিকরাও বেকার ও কর্মহীন হয়ে পড়েন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিষয়টি উপলব্ধি করে সাংবাদিকদের মাঝে করোনা-কালীন আর্থিক সহায়তা হিসাবে প্রথম পর্যায়ে ৩ কোটি ৩৫ লাখ টাকা বরাদ্দ প্রদান করেন, যা দেশের ৩ হাজার ৩৫০ জন সাংবাদিকের মাঝে বিতরণ করা হয়। করোনা প্রাদুর্ভাব বিবেচনা করে প্রধানমন্ত্রী পুনরায় সাংবাদিকদের আর্থিক সহায়তা অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে তাঁর নিজস্ব তহবিল থেকে অর্থ বরাদ্দ করেন। দ্বিতীয় পর্যায়ে বরাদ্দকৃত অনুদান থেকে সারা দেশের ৬ হাজার ৭২৭ জন সাংবাদিককে ১০ হাজার টাকা করে ৬ কোটি ৭২ লাখ ৭০ হাজার টাকা করোনা-কালীন আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়।
২০১১ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ১৩ বছরে সারা দেশে ৪৩ কোটি ৬৯ লাখ ২০ হাজার টাকা মোট ১৪ হাজার ১৩৩ জন সাংবাদিকের মাঝে আর্থিক অনুদান হিসাবে বিতরণ করা হয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্ট সাংবাদিকদের মেধাবী সন্তানদের জন্য মঞ্জুরি, বৃত্তি ও স্টাইপেন্ড প্রদান নির্দেশিকা ২০২৩-এর অধীনে পঞ্চম শ্রেণি থেকে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত মঞ্জুরি, বৃত্তি ও স্টাইপেন্ড কার্যক্রম শুরু করেছে।
সাংবাদিকদের আর্থিক সহযোগিতার পাশাপাশি দক্ষতা উন্নয়নে কাজ করছে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়। প্রশিক্ষিত ও দক্ষ সাংবাদিক গড়ে তুলতে প্রেস ইন্সটিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি) সাংবাদিকতায় বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণের আয়োজন করে থাকে। ২০০৯ সাল থেকে ২০২৩ সালের আগস্ট পর্যন্ত পিআইবি পরিচালিত ১ হাজার ১৭২টি প্রশিক্ষণ কোর্সে মোট ৩৮ হাজার ৯৯৫ জন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন। এর মধ্যে পুরুষ ৩৪ হাজার ৬৫৪ জন এবং নারী ৪ হাজার ৩৪১ জন।
সাংবাদিকদের দক্ষতা উন্নয়নে বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল প্রশিক্ষণ কর্মশালা ও মতবিনিময় সভা আয়োজন করে থাকে। ২০০৯ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় অনুষ্ঠিত প্রশিক্ষণ কর্মশালা ও মতবিনিময় সভায় প্রায় ৫ হাজার সাংবাদিক অংশগ্রহণ করেন। এ ছাড়া তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের অধীন অন্যান্য দপ্তর-সংস্থা, আঞ্চলিক তথ্য অফিস ও জেলা তথ্য অফিসসমূহ নিয়মিত সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা আয়োজন করে।
সরকার ২০০৯ সালে তথ্য অধিকার আইন প্রণয়ন করে। এই আইন প্রণয়নের ফলে তথ্য-প্রাপ্তির আইনি অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই আইনের মাধ্যমে তথ্য-প্রাপ্তির সকল প্রতিবন্ধকতা দূর হয়েছে এবং অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা বিকাশ লাভ করেছে।
সরকারের উদারনীতির কারণে দেশে ৪৪টি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল, ২৮টি এফএম রেডিও ও ৩২টি কমিউনিটি রেডিও-এর লাইসেন্স প্রদান করা হয়েছে। সরকারের আন্তরিকতার কারণে দেশে প্রিন্ট ও অনলাইন গণমাধ্যমের সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে। গণমাধ্যমের সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে সাংবাদিকদের কাজের ক্ষেত্র বেড়েছে এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে।
দেশে গণমাধ্যমের সংখ্যা যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে, তেমনি গুজব ও হলুদ সাংবাদিকতার পরিমাণও বেড়েছে। তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করতে গুজব ও হলুদ সাংবাদিকতাকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করতে হবে। গুজব ও হলুদ সাংবাদিকতা প্রতিরোধে সাংবাদিকসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।
দুর্নীতি প্রতিরোধ ও দেশের সার্বিক উন্নয়নে গণমাধ্যমের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের কল্যাণে সরকার কাজ করে যাচ্ছে। সরকারের কার্যকর উদ্যোগ এবং সাংবাদিকদের দায়িত্বশীল ভূমিকার সমন্বয়ে বাংলাদেশের গণমাধ্যম বিকশিত হবে— এটিই প্রত্যাশা। (পিআইডি ফিচার)
লেখক : মোঃ মামুন অর রশিদ
সিনিয়র তথ্য অফিসার,
আঞ্চলিক তথ্য অফিস, রংপুর।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।