সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহের আগত দিনগুলো সহজ হবে না। ইতোমধ্যেই গ্রাম-মফস্বলের প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে নূরানি মাদরাসা, কিন্ডারগার্টেন এবং প্রি-ক্যাডেট স্কুল/মাদরাসা এবং শহরাঞ্চলে বেসরকারি স্কুল ও ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের আধিক্য বাড়ছে। অভিভাবকরা অনেক অভিযোগ নিয়ে সন্তানদেরকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বিকল্প স্কুল/মাদরাসায় পাঠাচ্ছে। গ্রামাঞ্চলে এমনও প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে যেখানে পাঁচ শ্রেণি মিলিয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা অর্ধশতকের নিচে। আবার হাজিরা খাতায় যত শিক্ষার্থীর নাম আছে বাস্তবতায় আছে আরও অনেক কম।
অভিভাবকদের সবচেয়ে বড় আপত্তি, শ্রেণীকক্ষে দীর্ঘ সময় অবস্থান। ভৌগোলিক অবস্থান ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় দুপুরের খাবার শারীরিক গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। স্কুলের দিনগুলোতে সেটা থেকে শিক্ষার্থীদের বঞ্চিত হতে হচ্ছে। সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৪.০০ মিনিট পর্যন্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবস্থানকালে হওয়ায় শিক্ষার্থীদের জন্য শারীরিক ও মানসিক চাপ হচ্ছে এবং অভিভাবকরাও সন্তুষ্ট নয়। শিফট ভেদে কিছুটা ভিন্নতা থাকলেও বিতর্কের জায়গাটি বড়!
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বিকল্প না থাকার যুগে শিক্ষার জন্য প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যেতেই হত। এখন বিকল্প এবং বিকল্পেরও বিকল্প হাজির হয়েছে। যে কারনে বছর বছর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির হার কমছে। হাজিরা খাতায় হয়তো নাম আছে কিন্তু ক্লাস করছে অন্যকোন প্রতিষ্ঠানে! গবেষণায় এটাও দেখা গেছে, শিখণফল অর্জনের ক্ষেত্রে বেসরকারি স্কুলগুলোর শিক্ষার্থীরা ভালো অবস্থানে আছে। অথচ তাদের স্কুলিং টাইম ৯টা থেকে ২টা পর্যন্ত, কোথাও কোথাও আরও কম। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যেভাবে যাচাই-বাছাই করে মেধাবী ও যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয় বেসরকারি স্কুলগুলো সেসবের ধারে কাছেও নাই।
অনার্স-মাস্টার্সে অধ্যয়নরতদের দিয়ে, কোন রকমের প্রশিক্ষণ-বিহীন, কোথাও ভালো চাকুরি হচ্ছে না এমন শিক্ষক দিয়ে নূরানি মাদ্রাসা সুনামের সাথেই চলছে! প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের তুলনায় বেতন কম এবং শিক্ষার্থী অনুপাতে শিক্ষকদের সংখ্যাও কম! তবুও সম্ভব হচ্ছে! প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা দীর্ঘসময় (প্রায় ৭ ঘণ্টা) স্কুলে অবস্থান করে! একথা সর্বজন স্বীকৃত যে, মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষকদের তুলনায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণকে ক্লাসে অধিক কথা বলতে হয়, মস্তিষ্কের শ্রম দিতে হয় এবং শিক্ষার্থীকে ধরে ধরে শেখাতে হয়। এটা অবশ্যই শ্রমসাধ্য ও সাধনা-সিদ্ধ ব্যাপার। যে কারনে শিক্ষকদের প্রাণচাঞ্চল্য, সঞ্জীবনা ধরে রাখা অত্যন্ত কঠিন হয়ে যায়। এটা তো স্বভাবসিদ্ধ, মানুষ যখন কুলিয়ে উঠতে পারে না তখন দায়িত্ব এড়ানোর সুযোগ খোঁজে।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কর্মরত শিক্ষকদের বৃহদাংশ নারী শিক্ষক। যাদের প্রত্যেকের স্কুলে পাঠদানের বাইরেও আরও বড় দায়িত্ব থাকে। সংসার সামলাতে হয়। সবার খাবার প্রস্তুত করতে হয়। সন্তানদের শিক্ষা-স্বাস্থ্যের তদারকি করতে হয় । মানুষ তো মেশিন নয়। সবকিছু সামলিয়ে স্কুলে এসে পূর্ণদম নিয়ে ক্লাসে মনোযোগ দিতে পারে এমন মানসিক শক্তি ও শারীরীক্ষ সক্ষমতা ক’জন কর্মজীবী নারীর থাকে! তবুও দায়িত্বের খাতিরে লড়তে হয়। পুরুষ শিক্ষকদের বেলায় সংসারের আর্থিক বিষয়ের দায়িত্ব নিতে তাকে বিকল্প আয়ে সময় দিতে হয়। এটা বলা বাহুল্য হবে না যে, বর্তমান বাস্তবতায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতনের অঙ্ক ততটা স্বাস্থ্যবান নয়।
কোমল-মতি শিক্ষার্থীদের যতক্ষণ আটকিয়ে রাখা যাবে তাদের জ্ঞানের বহর তত প্রশস্ত হবে-এমন যুক্তি বোধহয় কোন গবেষণায় সত্যায়ন করেনি। শিক্ষার পরিবেশ যদি আনন্দময় না হয় তবে শিক্ষার্থীদের মধ্যে শিক্ষার প্রতি বিতৃষ্ণা তৈরি হয় এবং শেখায় অংশগ্রহণ থাকে না। যদি জরিপ করা হয়, বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্ত পরিবারের, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কর্মকর্তাদের কত শতাংশ সন্তান প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত? হারটা নিশ্চয়ই উদাহরণ দেয়ার পর্যায়ে পৌঁছাবে না।
যতগুলো কারনে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় বিমুখতা তার মুখ্য কারণ হিসেবে স্কুলে দীর্ঘসময় অবস্থানকালকে দায়ী করতে হবে। বিকল্প কোন সুযোগ পেলে, এমনকি প্রাথমিকের সম-গ্রেডে অন্যকোন চাকুরির সুযোগ হলে প্রাথমিকের শিক্ষকগণ চাকুরি ছেড়ে চলে যাচ্ছে। বিসিএসের নন-ক্যাডার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পদে সুপারিশ পেয়েও অনেক যোগদানের প্রশ্নে দ্বিধান্বিত থাকে! সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এই ত্রুটির জায়গাগুলোতে প্রাথমিক ও গণশিক্ষার নতুন অভিভাবকে সাহসী ও যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত নিতে হবে। একজন শিক্ষক নিশ্চয়ই শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের সুবিধা-অসুবিধাগুলো বিবেচনা করে শিক্ষার স্বার্থে নির্মোহ সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষম হবেন।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে স্কুলিং টাইম নিয়ে নতুন সিদ্ধান্তে পৌঁছানো জরুরী। শিক্ষার্থীদের মঙ্গল হয়, খেলাধুলা করার জন্য একটা বিকেল পায়, শিক্ষকরা কর্মোদ্যম নিয়ে শিক্ষাদান ধারাবাহিক করতে পারেন এবং চাকুরির বেতনের উৎস থেকেই আর্থিক প্রয়োজনীয়তার সংকুলান হয় সেই সিদ্ধান্ত রাষ্ট্রকেই দিতে হবে। স্কুল টাইম এবং যাতায়াত মিলিয়ে দিনের ৯-১০ ঘণ্টার মত সময় স্কুলিংয়ে দিলে না যায় স্কুলের দায়িত্ব পালন না হয় ঠিকঠাক সংসার। তখন দায়িত্বের ক্ষেত্রে সতত ও নৈতিকতার প্রশ্ন গৌণ হয়ে দাঁড়ায়।
প্রশ্ন উঠতে পারে, এসব শর্ত মেনেই তো চাকুরিতে যোগদান! সমাজ ও রাষ্ট্রের চোখে সবচেয়ে ছোট চাকুরি থেকে যেখানে শিক্ষার ভিত্তি রচিত হয় সেখানে শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের স্বার্থ বিবেচনা করা বড্ড জরুরী। সরকারি প্রাথমিকের গতিপথ মসৃণ রাখতে, আরও বেশি উপকারী ফলাফল পেতে শিক্ষার্থীদের মানসিকতা ও শিক্ষকদের পারিশ্রমিক নিয়ে ভাবনাটা জরুরী। শিক্ষায় রূপায়ন, স্মার্ট সিটিজেন-এ সকল লক্ষ্য পূরণে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের স্বার্থ বিবেচনার কোন বিকল্প নাই। পাহারা বসিয়ে সংখ্যা বাড়ানো যায় কিন্তু মান কতোটা বাড়ে-সে পরিসংখ্যান ইতিহাসে আছে। নজরদারির সাথে সক্ষমতার মিশেল হওয়ার জরুরি।
রাজু আহমেদ।
কলাম লেখক।
[email protected]
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।