All Menu

আমরা মাকে পেয়েছিলাম

শীতের সকালে ভাপা পিঠা, ক্ষুধা ভর্তি খেঁজুর রসের পায়েস, পিঠা পুলি আর মুড়ির মোয়া বিগত শতাব্দীর শেষভাগে আমাদের মায়েরা আমাদেরকে খাওয়াতেন। হরেক রকমের পিঠা, কয়েক ধরনের তরকারি, ধোঁয়া ওঠা অনেক নামের ভাতের সাথে মা আমাদেরকে পরিচয় করে দিতেন। নিত্য নতুন রেসিপি দিয়ে মা আমাদের চমকে দিতেন! কি ভালো রাঁধতেন মা! হাড়িতে পাতা কাজী-ভাতের স্বাদ এখনো জিহ্বায় লেগে আছে! চাল ভাজি করে নারিকেল এবং গুড় দিয়ে মাখিয়ে, লাতা ভাজা খাওয়ায়ে আমাদেরকে স্বাস্থ্যবান হিসেবেই বড় করে তুলতেন।। সন্ধ্যার পরের তদারকিতেই আমরা ভালো রেজাল্ট করতাম। জানার ক্ষেত্রেও যে পিছিয়ে থাকতাম সে অভিযোগ উত্থাপনের সুযোগ নাই। অনেক কিছু না জানলেও যা জানতাম তা আদি-নক্ষত্রসহ জানতাম। ঘুমাতে যাওয়ার কালে মজার মজার গল্প বলে মা আমাদেরকে পরীর দেশে, রাজার দেশে, গহীন জঙ্গলে, ভূতের ঢেরায় নিয়ে যেতেন। আমরা সুখেই দিন কাটাতাম। বাবাকে একটু একটু ভয় পেলেও মা ছিলেন আমাদের বন্ধু। তিনি পরম যত্নে আগলে রাখতেন।
সন্তান দূরে পড়তে যায় বলে বিদায়ের সময় মা টিন ভর্তি পিঠা, গুড়-সন্দেশ সাথে দিয়ে বারবার বলে দিতেন রোজ সকালে যেন খাই। হোস্টেল কিংবা মেসের খাদক বন্ধুরা সকাল হওয়ার আগেই যে সব সাবাড় করে ফেলত তা মাকে কোনদিন বলা হয়নি! ধান সিদ্ধ করার সময় ঢোঙায় ডিম এবং আলু সিদ্ধ করে পাশে বসিয়ে পরম যত্নে খাওয়াতেন। দুপুর এবং রাতে মায়ের প্লেট থেকে কয়েক লোকমা না খেতে পারলে ক্ষুধা থেকেই যেত। কাঠ বাদাম, তালের শাস, ছোট্ট শসা, কুড়ানো বরই, বাগানে পাওয়া আম-লিচু সংগ্রহ করে মা মাতৃত্বের যত্নে আগলে রাখতেন। মায়ের আঁচলে থাকা আধুলি-টাকা কখন লাপাত্তা হয়ে যেত মা টের পেতেন না কিন্তু এমন প্রকাশ্যে মা পয়সা-কড়ি সেজন্যই বোধহয় রাখতেন যেন সন্তানে নিয়ে আইসক্রিম-লাঠির চকলেট খায়!
রাজ্যের সব কাজ সামলাতে গিয়ে মা সন্তানের খোঁজ রাখতে, গোসলের সময় সন্তানের শরীর পরিষ্কার করে দিতে, সন্তানের ময়লাযুক্ত জামা ধোলাই করে দিতে মাকে কখনোই মনে করিয়ে দিতে হয়নি। সংসারে কত শত প্রতিকূলতার মাঝেও মা সন্তানকে বুকের সাথে আগলে রেখেছেন। ঘুমানোর সময় মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছেন, স্কুলের জন্য প্রস্তুত করে দিয়েছেন, টিফিনের ব্যবস্থা করেছেন এবং বাবাকে লুকিয়ে আলাদা পয়সা দিয়েছেন। আমরা সেই মা পেয়েছিলাম যারা সন্তানের জ্বর আসলে নিজেরাই ওষুধ হতেন। সন্তানের শত অপরাধ বাবার থেকে লুকিয়ে রাখতেন। মা যদি দুষ্টামির খতিয়ানের কিঞ্চিৎ বাবার সামনে তুলতেন তবে পৃষ্ঠদেশ কি আজকের মত মসৃণ থাকত? সন্তানের মঙ্গলের জন্য নিজের সকল ধরনের ভোগকে অনায়াসে ত্যাগ করতেন। কত-শত দিন মা ভালোটুকু না খেয়ে, নিজে না নিয়ে সবটুকু সন্তানকে দিয়েছে-সে হিসাব কি কোন সন্তান রেখেছে?
সেই প্রজন্ম হারিয়ে গেছে তাদের সেই চরিত্রের মা হারানোর সাথে সাথেই। এই প্রজন্মের দুঃখের কথা বলছি না। এ প্রজন্মের সন্তানেরা এক-দুয়ের অধিক পিঠার নাম জানে না। হরেক রকমের ভর্তা চেনে এমন সংখ্যাও দিন দিন কমে আসছে। ঘুমানোর সময় গল্প,, দিনের বেলায় অল্প সময় দেয়ার সময় ও রীতি হারিয়ে যাচ্ছে। সন্তানের কাছে এখন মোবাইল হচ্ছে মা এবং বাবা। সন্তানের কাছে খাওয়ার সময় মোবাইল, ঘুমানোর সময় মোবাইল, একা থাকার সময় মোবাইল, সবার মাঝে থাকার সময়েও মোবাইল। ভাই-বোনের বন্ধন শিথিল হয়ে গেছে, পিতামাতা-সন্তানের মাঝে দূরত্ব বেড়েছে। আমাদের ফ্রিজ আছে এবং রাইস কুকার কাছে। একই খাবার ঠাণ্ডা হতে থাকে আবার গরম হতে থাকে! সকালে দুপুরে রাত্রে! গত সপ্তাহের মাছ-মাংসটুকু এই সপ্তাহে আয়েশ করে খাই! মজা নাই, মজা নাই।
এখন সন্তানদেরকে অসীম প্রতিযোগিতায় ঠেলে দেয়া হচ্ছে। যেকোনভাবে সন্তানকে ভালো রেজাল্ট করাতেই হবে। তাইতো সন্তানের পাঠ্য বই সন্তানের চেয়ে মা পড়ছে বেশি! সন্তানের জন্য আমাদের মায়েরা বিকেল খুঁজে বের করতেন আর আজ-কালকার মায়েরা বাসায় পড়ানোর জন্য হালি হালি মাস্টার খুঁজে বের করেন। বর্ণমালা শেখার আগেই দেশ, মহাদেশ, রাজধানী এবং মুদ্রার নাম ঠোঁটস্থ করিয়ে দেন! এখনকার ছোট ছোট শিশুদের মস্তিষ্কে যে পরিমাণ টর্চার করা হয় আমাদের মায়েরা তা করতো না! তবুও দেশ চালাতে যে ক’জন, সমাজ চালাতে যে ক’জন, পরিবার চালাতে যে ক’জন দরকার তা দক্ষভাবেই তৈরি হত! ডাক্তার মানবিক ডাক্তার হত! উকিল আদর্শিক উকিল হত! আজকালকার ইমাম-মুয়াজ্জিনের চেয়েও তখনকার আমজনতা উত্তম চরিত্রের ধারক ও সৎ আদর্শের বাহক ছিল! অশিক্ষিত মায়েরাই নৈতিক প্রজন্ম সৃষ্টি করত। সে এক সুন্দর সময় ছিল! যা আজ-কালকার দিনে গল্প মনে হয়!
আমি আমার সন্তানকে নিয়ে উদ্বিগ্ন। আমাদের সন্তানদের সুন্দর শৈশব থাকবে না। গল্প বলার মত স্মৃতি-অভিজ্ঞতা থাকবে না। রবোটিক মানুষ হিসেবে বেড়ে উঠবে। যেখানে থাকবে চিন্তার অসুস্থতা, মানসিক দুর্বলতা। আবেগ-অনুভূতির জায়গা বন্ধ্যা হয়ে যাবে এবং মানবিকতার বোধ লোপ পাবে। শীতের সকালে চুলার পাশে রসের পায়েসের স্বাদ আর কোনদিন পাবে না। মায়ের কাছে গল্প শোনার সময় সন্তানেরও হচ্ছে না আবার মায়েরও অখণ্ড অবসর নাই। সবাই যার যার মত ব্যস্ত।
শুধু মায়ের কথা বলছি বলে ভাবছেন, সব দোষ মাকে দিচ্ছি? একটুও না। মোটেও না। আমাদের প্রজন্মের বাবারা একটু কেমন জানি! প্যারেন্টিং বলতে ভালো স্কুলে শিক্ষা ও যত্ন বলতে ভালো পোশাক এবং খাদ্যকেই বোঝে! সন্তানের সাথে কথা বলার, তাকে ভালো-মন্দের পার্থক্য না বুঝিয়ে নিজেদের সিদ্ধান্ত সন্তানদের ওপর চাপিয়ে দেয়ার প্রবণতা তৈরি হয়েছে! আমরা মমতা-ভালোবাসা কম দেখিয়ে বেশি বেশি টাকা এবং ভবিষ্যৎ দেখাচ্ছি। হয়তো একদিন এর বেস-কিছুর বিনিময় আবার আমাদের দিকেই ফেরত আসবে! সেদিন নিজেদের ভুল নিয়ে ঠাট্টা করে হাসবো! এর আর বিকল্প কি? আমরা সুন্দর একটা শতাব্দী হারিয়ে ফেলেছি যেখানে মানুষেরা রাত্র গভীর হওয়ার পূর্বেই ঘুমাতে যেত এবং সূর্য মুখ দেখানোর আগেই মানুষেরা জেগে উঠত! এখন আমরা ডিভাইসের দাসে পরিণত হয়েছি!

রাজু আহমেদ।

কলামিস্ট।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top