ময়মনসিংহে বন্যা পরিস্থিতি চরম অবনতিতে প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা,২১ ইউনিয়নে দেড় লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি,তিন উপজেলায় বিদ্যুৎ সংযোগ-মোবাইল নেটওয়ার্ক নেই, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে বিপাকে মানুষজন। অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট, ধোবাউড়া ও ফুলপুর উপজেলার বন্যা পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়েছে। পানির চাপে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হওয়ায় তিন উপজেলার ২১ ইউনিয়নের দেড় লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। তিন উপজেলাতেই বিদ্যুৎ সংযোগ এবং মোবাইল নেটওয়ার্ক নেই। এতে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে বিপাকে পড়েছেন মানুষজন।বন্যায় জেলা-জুড়ে মৎসখাতে কমপক্ষে ৫ হাজার ৯৮৮ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।
রবিবার (০৬ অক্টোবর ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ) দুপুরে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন, জেলা ত্রাণ ও দুর্যোগ পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. সানোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, উপজেলার প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোকে আশ্রয় কেন্দ্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে এখন নারী শিশুসহ দেড় সহস্রাধিক মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। তিন উপজেলায় ৩০ মেট্রিকটন খাদ্য সহায়তা দেয়া হয়েছে। দুর্গতদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম চলছে। এছাড়া রান্না করা খাবারও দেয়া হচ্ছে বন্যা দুর্গতদের। তবে, এখন পর্যন্ত কোন হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি। স্থানীয় সূত্র জানায়, ধোবাউড়া বন্যা দুর্গতদের মাঝে শুকনো খাবার ও বিশুদ্ধ পানির চরম সংকট দেখা দিয়েছে। তাদের খাবারের ব্যবস্থা করছেন প্রশাসন। এছাড়াও নেতাই নদীর আশপাশের এলাকায় অন্তত অর্ধশত ঘরবাড়ি বিলীন হয়ে গেছে। পানিবন্দি অনেকে বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিচ্ছে। উপজেলার কলসিন্দুর, জিগাতলা, পঞ্চনন্দপুরসহ বিভিন্ন পয়েন্টে নেতাই নদীর বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করে। এতে পুরো উপজেলা প্লাবিত হয়েছে। এদিকে হালুয়াঘাটের প্রায় সব ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। তলিয়ে গেছে হাজার হাজার হেক্টর জমির ধান, সবজি খেত ও ভেসে গেছে পুকুরের মাছ। পানিবন্দি হয়ে আছে হাজার হাজার মানুষ। ঘরের মধ্যে পানি ঢোকার কারণে রান্নার কাজও ব্যাহত হচ্ছে। অনাহারে-অর্ধাহারে দিনাতিপাত করছে তারা। অপরদিকে ফুলপুর উপজেলার ছনধরা, রামভদ্রপুর, সিংহেশ্বর ও, ফুলপুর ইউনিয়নের অধিকাংশ ও অন্যান্য ইউনিয়নের আংশিক এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। এসব এলাকার আমন ফসল ও সবজি খেত তলিয়ে গেছে। ভেসে গেছে মাছের খামার। উপজেলা সদর থেকে কলসিন্দুর পাকা রাস্তা, ঘোষগাঁও ধোবাউড়া পাকা রাস্তা, ঘোষগাঁও বালিগাঁও পাকা রাস্তা, মুন্সিরহাট বাজার থেকে শালকোনা পাকা রাস্তা বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। জেলা কৃষি অফিস সূত্র জানায়, জেলার ধোবাউড়া উপজেলায় নিমজ্জিত ধান ১১ হাজার ৭০০ হেক্টর, সম্পূর্ণ নিমজ্জিত ৭ হাজার ৫০০ হেক্টর, আংশিক নিমজ্জিত ৪ হাজার ২০০ হেক্টর ও সবজি ৬০ হেক্টর। হালুয়াঘাটে নিমজ্জিত ধান ৭ হাজার ৬০০ হেক্টর, সম্পূর্ণ নিমজ্জিত ৪ হাজার ১০০ হেক্টর, আংশিক নিমজ্জিত ৩ হাজার ৫০০ হেক্টর ও সবজি ৭৫ হেক্টর। ফুলপুরে নিমজ্জিত ধান ৩ হাজার ৬৩০ হেক্টর, সম্পূর্ণ নিমজ্জিত ১ হাজার ৪৮০ হেক্টর, আংশিক নিমজ্জিত ২ হাজার ১৫০ হেক্টর ও সবজি ৬২ হেক্টর। আমতৈল গ্রামের সিদ্দিক মিয়া বলেন, রাস্তাঘাটে পানি, ঘরে, রান্না ঘরে পানি। কোথায় কোন শুকনা খাবার পেলাম না। তাই হাতেই ফিরতে হয়েছে। আমাদের বেঁচে থাকার জন্য খাদ্য সহায়তা প্রয়োজন। কৈচাপুর গ্রামের বাসিন্দা আবুল কাশেম বলেন, এমন বন্যা আগে কখনও দেখি নাই। ১৯৮৮ সালের বন্যা দেখেছি, এমন পানি ছিল না। বাড়ি ঘরে পানি উঠেছে। গরু ছাগল নিয়ে বিপদে আছি। গরু পানির মধ্যে বাধা। আমরা খুব সমস্যা আছি। চলাফেরা খুব সমস্যা, রাস্তায় বুক সমান পানি। ফসলের অনেক ক্ষয় ক্ষতি হয়েছে। আমন ধান পানির নিচে পড়ে গেছে। এবার আমন ধান পাবো, এমন আশা করা যায় না। অনেক শাকসবজি জমি তলিয়ে গেছে। স্থানীয়রা বলেন, সীমান্তবর্তী হালুয়াঘাট, ধোবাউড়া, নালিতাবাড়ী, ঝিনাইগাতি এসব এলাকায় পাহাড়ি ঢল এবং অতিবৃষ্টির কারণে প্লাবিত হয়েছে, এরকম পানি বিগত ১৫-২০ বছরে আর হয়নি। এখানে রাস্তা ঘাট, ব্রীজ, কালভার্ট, মানুষের বাড়ী ঘর, জমির ফসল গরু ছাগল, হাঁস মুরগী সব নষ্ট হয়ে গেছে।এ পরিস্থিতিতে হঠাৎ করেই পাহাড়ি ঢল ও বন্যায় বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। ময়মনসিংহ জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন বলেন, অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে ৭ হাজার ৮০ জন মৎসচাষি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অবকাঠামোর ক্ষতি হয়েছে ২১৭ লাখ, ভেসে গেছে ৫ হাজার ৬২৪ লাখ টাকার মাছ ও রেনোপোনা ভেসে গেছে ১৪৯ লাখ টাকার। মৎসখাতে মোট ৫ হাজার ৯৮৮ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। রবিবার (০৬ অক্টোবর ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ) পরিস্থিতি পরিদর্শন শেষে ময়মনসিংহ বিভাগীয় কমিশনার উম্মে সালমা তানজিয়া বলেন, আমাদের সকল ধরণের প্রস্তুতি আছে। বন্যাদুর্গত মানুষের খাদ্যসহ, যে চাহিদা সে মোতাবেক সরকার আমাদের পর্যাপ্ত পরিমাণ সহায়তা দিয়েছে। প্রতি ঘণ্টা ঘণ্টা আমাদের সচিব স্যার প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের সাথে কথা হচ্ছে। উপজেলাগুলোতে ৫৮ টি আশ্রয় কেন্দ্র ঘোষণা করেছি। সবাই একসাথে কাজ করছে। তাদের জন্য রান্না করা খাবার শুকনো খাবার দেওয়া হচ্ছে। সবাই মনে করছি যদি বৃষ্টিটা কমে যায় তাহলে পানি নেমে যাবে এবং পরিস্থিতির উন্নতি হবে।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।