এক।
ছোট্ট শহরগুলোতে বসবাসকারীদের জীবনযাপন রোজকার শব্দের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছে। শব্দের অত্যাচারে নেমে এসেছে নাভিশ্বাস। সে-কি আর যেই-সেই শব্দ! শব্দে শব্দে যেন বজ্রপাত! সকাল সকাল স্কুল/মাদ্রাসার পরিচিতিমূলক মাইকিং তো মধ্য দুপুরে ডায়াগনস্টিক সেন্টারের কিচ্ছা। চলন্ত বিকেলে ডাক্তারের যোগ্যতা তো পড়ন্ত বিকেলে ফেরিওয়ালাদের উৎপাত। তাদের বোধহয় বিশ্বাস জন্মেছে, আজকাল নিচু স্বরে বললে কেউ কিছু শোনে না! লিফলেট দিলে সেসব কেউ পড়ে ন। কাজেই কানের কাছে মাইক লাগিয়ে শোনাতেই হবে!
এছাড়াও যানবাহনের প্যাপু শব্দে মানুষের স্থিরতা ধরে রাখাই চ্যালেঞ্জ। চালকরা হর্নের বোতামে আঙুল যেন দিয়েই রাখে! শব্দ করতে না পারলে যেন হাত চুলকায়! যদি কোন বিশেষ দিবস আসে তবে তো কথাই নাই! শব্দ তো আর বিরক্তি বোঝে না! তখন সন্ত্রাসে পরিণত হয়। আজকাল গায়ে হলুদ, বিবাহ, সুন্নতে খৎনা, আকীকাসহ যেকোনো উপলক্ষ পেলেই সারা-দিনরাত উচ্চ-শব্দে সাউন্ড-বক্সে অরুচি-কুরুচিপূর্ণ গান-বাজনা প্রলয় তোলে। এতে পাড়াপড়শির কে বিরক্ত হয়, কে গালি দেয় সেসব আমলে নেওয়ার সময় কোথায়? কেউ কেউ তো অন্যকে গালিও মাইকে দিচ্ছে! চলন্ত সার্কাসে পরিণত হয়েছে মানুষের বিচরণ ভূমি!
এতক্ষণ তো দিনের সমস্যার কথা বললাম! শব্দ দূষণে রাতের সমস্যা আরও প্রকট। শিক্ষার্থীদের পড়ার সময়, পরীক্ষার্থীদের প্রস্তুতির সময়, শিশু ও অসুস্থ বৃদ্ধদের বিশ্রামের সময়, কর্মজীবীদের ক্লান্তি দূর করার সুযোগ নিয়ে যে নিরিবিলি রাত্রি আসার কথা সে আসতে পারে না! তাকেও শব্দের উচ্চকম্পণ থামিয়ে দেয়! রাতের তিন প্রহর পর্যন্ত ঘুমানোর অবস্থা থাকে না। মাইকের বিকট শব্দে সাধারণ জীবনযাপনে বিতৃষ্ণা ধরিয়ে দেয়। ধর্মীয় মজমায় এত উচ্চ-শব্দের সাউন্ড সিস্টেম ব্যবহার করা হয় যা আতঙ্কে পরিণত হয়। উন্মুক্ত কনসার্ট, বিভিন্ন পণ্যের প্রমোশনাল বিজ্ঞাপনে যে শব্দ-জট সৃষ্টি করা হয় তা মানুষের সহ্যসীমাকে বারবার পরীক্ষায় ফেলে!
দুই।
মাহফিল-পূজা বারবার হোক। সামাজিক অনাচার-ক্ষত দূর করার জন্য ধর্মীয় জলসাগুলোকে উৎসাহিত করতে হবে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি মেনে ধর্মীয় উৎসব হোক। আয়োজক-শ্রোতার পুণ্য ও কল্যাণ বয়ে আনুক। তবে অর্ধরাত্রি পর্যন্ত বিকট শব্দে মাইক বাজিয়ে এসব না করলে সওয়াব আরও বেশি হবে। যে পরিমণ্ডলে আয়োজন শব্দকে সেই গণ্ডিতে রাখতে পারলে তবেই ধর্মের শিষ্টাচার পালিত হবে। ডজন ডজন মাইক দিয়ে আশপাশের কিলোমিটারের পর কিলোমিটারের মানুষকে উত্যক্ত, বিরক্ত করলে সেটা অধর্মের কর্মকাণ্ড হবে। মানুষকে রাতের পর পর স্বাভাবিকভাবে ঘুমাতে না দিয়ে ত্যক্ত-বিরক্ত করলে, শব্দ-বোমা দিয়ে ঘুমের বারোটা বাজিয়ে রহমত কামনা করতে গেলে তার বদলে লানতের অংশী-জন হওয়া লাগতে পারে! রাজনীতিতে ব্যবহৃত মাইক নিয়ে মানুষ বিরক্ত হয়ে চুপ থাকতে বাধ্য হলেও অধর্মের মাইক সম্পর্কে খোদার কাছে নালিশ করবে না?-তা বন্ধ করবেন কীভাবে?
আয়োজনের বাইরে উচ্চ-শব্দ ব্যবহার করে এসএসসি/দাখিল সমমান পরীক্ষার্থীদের দীর্ঘ সময়ের স্বপ্নে পেরেক ঠুকবেন না-দয়া করে। পরীক্ষার্থী সন্তানদের অভিভাবকদের নিশ্চিন্তে থাকতে দিন। রাতে ওদের পড়তে দিন। এই যে মাইক লাগিয়ে মানুষের বিরক্তির কারণ হচ্ছেন, লম্বা সুর টান দিচ্ছেন/শুনছেন এতে দ্বীনের কতখানি উপকার হয় তা নিরপেক্ষভাবে ভাববেন! উন্নত মুসলিম রাষ্ট্রগুলোতে ধর্মের যে শিষ্টাচার আছে তা আমাদের মাঝেও প্রবেশ করুক। জনগোষ্ঠীর বৃহদাংশ সচেতন হলে আমরা আরও আমলদার-দ্বীনদার ধার্মিক পেতাম। যদি স্পিকার ব্যবহার করতেই হয় তবে যতজন মানুষ মজলিসে বসেছে, তারা শুনতে পায় সেই মাত্রার সাউন্ড সিস্টেম ব্যবহার করুন! গোটা শহর-নগরকে শব্দ সন্ত্রাসে অস্থির করে ফেলাদের বোধ কি সন্ধ্যার আগেই ঘুমিয়ে যায়? ক্ষতিগ্রস্ত ভুক্তভোগীদের জায়গায় নিজেদেরকে বসিয়ে একটু কল্পনা করুন তো!
এই শহরে শিশু আছে, অসুস্থ বৃদ্ধ আছে তাদেরকে শান্তিতে ঘুমাতে দিন। কখনো কখনো মজমায় মজার চেয়ে ঘুমাতে পারলে বেশি পুণ্য হয়। যে ছেলেমেয়েরা পড়াশুনায় মগ্ন ওদেরকে নির্বিঘ্নে পড়তে দেওয়ার ব্যবস্থা হোক। উচ্চ-শব্দের মাইকে বয়ান করে, জোর করে শুনিয়ে শ্রোতার ইমানের, আখলাকে এবং আমলে কোন পরিবর্তন হয়েছে-তেমন দৃষ্টান্ত এখানে কোথায়? বরং হিতে-বিপরীত ঘটেছে সেই উদাহরণ বেশি! কোন ব্যাপারে বিরক্তির উদ্রেককারীরা অনুকম্পা পেয়েছে? বিরক্ত হলে কেউ সেটার প্রশংসা করে?
মানুষকে বিরক্ত করে ধর্ম হয়? এশার নামাজের পরে বেশি কথা বলতে রাসুল (সা.) স্বয়ং অনুৎসাহিত করেছেন অথচ আমরা ফরজ-সুন্নতের অনেককিছু ত্যাগ করে নফলের নামে রোজ রোজ পাড়ায় পাড়ায় মজমা বসাচ্ছি। রাতের পাখি, জন্তু-জানোয়ারের স্বাভাবিক জীবনযাপন ব্যাহত করে, মানুষের শান্তি বিনষ্ট করে, আসলে কার উপকার হয়? সেদিন নাজাতের বদলে না জানি কৈফিয়ত দিতে হয়! তাছাড়া আজকাল তো ইচ্ছা করলেই ইন্টারনেটে-মিডিয়ার কল্যাণে সবকিছুর লাইভ উপভোগ করা যায়, শোনা যায় এবং দেখা যায়। এসব সুযোগ থাকার পরেও কেন শব্দ-দূষণ ঘটাতে হবে?
ভালো আলোচনাগুলো মসজিদ কেন্দ্রিক হলে সেসবের প্রতিফলন সমাজে ঘটবে। অন্যায়-অবিচার এবং পাপাচার কমবে। বছরের একদিন খুব আয়োজন করে,, তবারক-শিন্নী বিলিয়ে উৎসব করলে তার রেশে ধর্ম ও ধার্মিকদের কতোখানি উপকার হয় তা ফেরেশতারা জানে! তবে শান্তির জীবন দুর্বিষহ করার ক্ষতিটুকু বোঝার বোধ মানুষের থাকুক। যতখানি জুড়ে শ্রোতা বসে, সেই পরিধিতে শব্দকে সীমাবদ্ধ রাখলে তাতে অধিক পুণ্য হবে বলে বিশ্বাস। শোন শোন, আমার বাড়িতে, আমার আঙিনায়, আমার পাড়ায় ওরস হচ্ছে-এই অহংকার জন্মালে পুড়তে হতে পারে!
বোধকে শাণিত করার মাধ্যমে রাতের শব্দ সীমিত হোক। শব্দ-দূষণ বন্ধ হোক। সন্ধ্যার নামার সাথে সাথেই পরিবেশকে শান্ত করা উচিত। নয়তো শব্দ-বোমার শাস্তি আগুনেও হতে পারে! আকাশ-জমিন ফাটানো ডিজে গান রাতভর সহ্য করে কোন মানুষ ঘুমাতে পারে? নিশ্চয়ই মানুষের অভিশাপ-আশীর্বাদ, পছন্দ-অপছন্দের মূল্য খোদার কাছে আছে। ধর্মের নামে, সংস্কৃতির নামে, উৎসবের নামে যাই করা হোক তাতে বিবেচনা-বোধের মিশেল থাকুক। রাষ্ট্রের কাছেও নীতিমালা থাকুক-রাতের কখন মাইকের মত উপদ্রব বন্ধ করে শান্ত পৃথিবী উপহার দেয়া যাবে। আইনে যা আছে তার বাইরেও বিবেকে কিছু থাকা উচিত। অন্যকে উত্যক্ত করে ভালোকাজের ফল লাভ করা কঠিন। বৌদ্ধিকভাবে আমাদের কাজগুলো যৌক্তিক হোক। যে রাতকে বিশ্রামের জন্য স্বয়ং খোদা মনোনীত করেছেন সেই রাত দিনের মত কোলাহলপূর্ণ না থাকুক। এতে অধার্মিকের চেয়ে ধার্মিক বেশি লাভবান হবে। জোরালো শব্দ হাতি তাড়াতে পারে বটে কিন্তু ইমান কতখানি জাগায় সেটা বিতর্কের অবকাশ রাখে!
রাজু আহমেদ। প্রাবন্ধিক।
[email protected]
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।